অ্যামাজনকে ধ্বংস করতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ‘অকার্যকর’ করেন বোলসোনারো

বিদেশ : ২০০৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলে বন উজারের ঘটনা ৮০ শতাংশ কমিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিল সে দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব দ্য এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড রিনিউবেল ন্যাচারাল রিসোর্স-ইবামা। তবে ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলে পরিবেশ সুরক্ষা সংক্রান্ত আইন সংকুচিত করতে শুরু করেন। ধাপে ধাপে এই রাষ্ট্রীয় সংস্থার কর্মক্ষেত্র সীমিত করার পাশাপাশি কমিয়ে দেওয়া হয় বাজেট।

আর বর্তমান ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই সংস্থাটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ক্ষমতায় আসীন হয়ে তিনি এর বাজেট ২৫ শতাংশ কমিয়ে দেন। সংস্থাটির শীর্ষ পদে এমন একজনকে নিয়োগ দেন, যিনি বন সুরক্ষার বদলে তার ধ্বংসের পথ করে দিচ্ছেন। রেকর্ড গতিতে প্রতিদিন পুড়ছে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ খ্যাত অ্যামাজন। ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্পেস রিসার্স (আইএনপিই) বলছে, এ বছর জুন পর্যন্ত ব্রাজিলে ৭২ হাজার ৮৪৩টি অগ্নিকা- হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি আগুনের ঘটনা অ্যামাজন জঙ্গলে, যা আগের বছরের তুলনায় ৮৮ শতাংশ বেশি। এসব অগ্নিকা-ের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দায়ী করা হচ্ছে পশুপালক ও কৃষকদের। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট অভিযোগ করেছেন, এনজিও সংগঠনের পক্ষ থেকে লাগানো হচ্ছে এসব আগুন।
আদিবাসী পরিবেশবাদীরা বলছেন, অ্যামাজনকে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করার সরকারি নীতির কারণেই আগুন লাগানোর মহোৎসব শুরু হয়েছে। এই বক্তব্যের সমর্থন মিলেছে রয়টার্স প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সে দেশের বন সুরক্ষায় নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় সংস্থা ইবামাকে ‘অকার্যকর’ করার মধ্য দিয়েই অ্যামাজনকে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করার পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। ইবামার বর্তমান ও সাবেক ১০ জনের সাক্ষাতকার নিয়ে, সরকারি নথি ও অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য সামনে এনেছে রয়টার্স। ২০০৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলে বন সংরক্ষণে দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকার কারণে বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছিল ইবামা। স্যাটেলাইট ছবি ও মাঠ পর্যায়ে কর্মীদের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নিতো তারা। তবে বামপন্থী প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ ২০১১ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর ইবামার ১৬৮টি স্থানীয় দফতরের ৯১টিই বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০১৫-১৬ সালে এই সংস্থার বাজেটও সংকোচন করা হয়। ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পরিবেশ মন্ত্রীর দায়িত্বপালন করা ইজাবেলা তেইশেইরা দাবি করেন, ‘অর্থনৈতিক সংকটের কারণে আমাদের অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, এটা শুধু পরিবেশে নয়, সবার জন্যই।’
ডানপন্থী বোলসোনারোর প্রশাসন ইবামার সঙ্গে প্রায় যুদ্ধাচরণ করেছে। নির্বাচনী প্রচারণার সময়ই ইবামার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন তিনি। তার অভিযোগ এটা ‘জরিমানার কারখানা’। দায়িত্ব নেওয়ার পর পাল্টে যায় পরিবেশ নীতি। রয়টার্স জানায়, সংস্থাটিতে বড়জোর এখন ৭৮০ জন এজেন্ট রয়েছেন; যা ১১ হাজার বর্গকিলোমিটারে একজন। আর এর ২৫ শতাংশ কর্মী যেকোনও সময় অবসরে যেতে পারেন। কর্মীরা জানান, তারা নিজেরাও নতুন বিধিনিষেধে অস্বস্তিতে রয়েছেন। অবৈধ এলাকায় পাওয়া গাছ কাঁটা ও খননের জিনিসপত্র ধ্বংস করতে পারেন না তারা।
গাছ সরানো ও কাটার ভারী জিনিসপত্র ধ্বংস করে দিলে অপরাধীরা আবারও এই কাজ করে না। আগের প্রশাসনে এই কাজটা করতে পারতেন মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা। তবে গত এপ্রিলে অ্যামাজনের রোনডনিয়ায় এমন কিছু জিনিসপত্র পুড়িয়ে দেওয়ার পর প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো এই নিয়ম বাতিল করেন। তিনি বলেন, কোনও কিছুই পোড়ানো ঠিক নয়। এটা নিয়ম না।’ এরপর থেকে ইবামায় নিয়োগ দেওয়া বোলসোনারোর নতুন প্রধান অলিভাদি অজেভেদো আর কোনও যন্ত্র পোড়ানোর অনুমতি দেন না। এ বছর এমন কতগুলো অনুরোধ প্রত্যাখ্যান হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেনি রয়টার্স। ২২ এপ্রিল বিমের কাছে দেওয়া এক চিঠিতে প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ২৫ জন বিভাগীয় প্রধান, এসপি এবং বিশ্লেষকরা এই কঠিন নীতির ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন। এই বিষয়ে অ্যাজেভোদো কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ইবামার প্রেস অফিস থেকে জানানো হয় তখন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে ওই অনুরোধ পাঠানো হয়।
এ বছর আরেকটি পরিবর্তন ছিলো পরিবেশ সুরক্ষায় কাজ করা বিশেষ বাহিনীকে অকার্যকর করে দেওয়া। বিষয়টির সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট চারজন রয়টার্সকে বলেন, ইবামা বিপজ্জনক ও দুর্গম এলাকায় অভিযানের জন্য এই বিশেষ বাহিনীর ওপর নির্ভর করতো। কিন্তু বোলসোনারো প্রশাসনের কর্মকর্তারা তা পরিবর্তন করে ফেলেছে। এই বিশেষ বাহিনীর নাম জিইএফ। তাদের সদস্য সংখ্যা ১৩। তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর মতো পরীক্ষা হয়। ইবামা তাদের পরিকল্পনা জিইএফকে জানালে তারা বাস্তবায়ন করে। তবে চলতি বছর বড়জোর ১০ বার তাদের মাঠে নামানো হয়েছে। অ্যামাজনের যেসব স্থানে বেশি অবৈধ কাজ হয় সেখানে জিইএফ এর অভিযান চালাতে চলতি বছর অন্তত দুইবার অনুরোধ করেছিলো ইবামা কর্মীরা। তবে পরিচালক আজেভোদো রাজি হননি। আর অন্যদিকে প্রতি মিনিটে হাজার হাজার বর্গফুট পুড়ে যাচ্ছে অ্যামাজনের।
ইবামা নামের এই সরকারি সংস্থার ব্যাপারে দেশটির কনজারভেটিভ প্রেসিডেন্ট জেয়ার বোলসোনারোর আক্রোশ গোপন কিছু নয়। প্রায়ই একে উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা বলে উল্লেখ করেন তিনি। ১ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণের পর ইবামার বার্ষিক বাজেট ২৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। বিরোধী দলের সংগ্রহ করা একটি অভ্যন্তরীণ নথি থেকে এই তথ্য পায় রয়টার্স। এই বাজেট কমানোর মধ্যে বনের আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থায়নই কমে ২৩ শতাংশ। ইবামার নতুন প্রধানও এই সংস্থার কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সংস্থাটির সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা রয়টার্সকে জানান, অবৈধ গাছকাটা, কৃষিকাজ ও খননের কারণে চলতি বছর অ্যামাজনের ১২ হাজার বর্গকিলোমটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেমন, সংস্থাটির মাঠপর্যায়ের কর্মীরা আগের মতো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না। পরিবেশ অপরাধ সংঘটিত স্থানে প্রাপ্ত ভারী জিনিসপত্র ধ্বংসের এখতিয়ার নেই তাদের। সংস্থার পাঁচজন সাবেক ও বর্তমান কর্মী বলেন, এতে করে ভূমি দখলকারীদের ধরা কঠিন ও ধীরগতির হয়ে যায়। এছাড়া ইবামার বন পুলিশের বিশেষ বাহিনীকে চলতি বছর অ্যামাজনে কোনও দায়িত্বপালন করতে দেখা যায়নি। পাঁচ বছর আগে আত্মপ্রকাশ করা এই উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অস্ত্রসজ্জিত বাহিনীর ক্ষেত্রে এমন ঘটনা এবারই প্রথম। তাদেরকে উল্টো ডেস্কে কাজ করতে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মীরা। ডেস্কে কাজ না থাকলে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এমন স্থান থেকে অনেক দূরে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের। বোলসোনারো দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিবেশ অপরাধীদের শাস্তিও কমে গেছে। ২৩ আগস্ট পর্যন্ত এমন অপরাধীদের দেওয়া জরিমানার অঙ্ক গতবছরের তুলনায় ২৯ শতাংশ কম। সরকারি হিসেব মতে, ওই শাস্তির সামষ্টিক মূল্য ৪৩ শতাংশ। সোমবার ৫৪ জন ইবামা কর্মী সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট এডুয়ার্ডো বিমের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে ব্রাজিলে পরিচালিত পরিবেশ নীতির ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। চিঠিতে তারা ইবামাসহ আরও কয়েকটি পরিবেশ সংস্থায় ছয়টি পরিবর্তন প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন। এরমধ্যে নতুন নিয়োগ, কার্যকরী স্বায়ত্বশাসন এবং পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহের কথা বলা হয়।
ব্রাজিলের পরিবেশ মন্ত্রণালয় ইবামার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে। সংস্থাটির বাজেট কমানো এবং অন্যান্য অভিযোগ নিয়ে বারবার তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও রয়টার্সের অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছে তারা। এক মুখপাত্র বলেন, ইবামার এই পরিবর্তনে পূর্ববর্তী সরকারের কারণে হয়েছে। এরমধ্যে প্রয়োজনীয় বস্তুর অপ্রতুল এবং মাঠপর্যায়ের দফতরে অদক্ষ ব্যবস্থাপনাও দায়ী।
মুখপাত্র দাবি করেন, অ্যামাজনের আগুন নিয়ন্ত্রণে ইবামা এখনও প্রশাসনিক পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এর আগেও মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছিলো যে তারা বন রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখে এবং অবৈধ বন উজারকে অপরাধ কার্যক্রম বিবেচনা করে।
সম্প্রতি অ্যামাজনের অগ্নিকা-ের ছবি ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনার মুখে পরে বোলসোনারো সরকারের পরিবেশ নীতি। দেশটির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্পেস রিসার্চ (আইএনপিই) এর তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে ব্রাজিলজুড়ে গত বছরের তুলনায় ৬৭ শতাংশ বেশি বন উজার করা হয়েছে। ২৪ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৮০ হাজার অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে, ২০১৩ সালের পর থেকে যা সর্বোচ্চ। পরিবেশবাদীরা বলছেন, ব্রাজিলীয় খামার মালিক ও কৃষকরাই ইচ্ছে করে আগুন লাগাচ্ছে যেন তারা তাদের কার্যক্রমের পরিধি বাড়াতে পারে। বোলসোনারোর সরকারের নীতিও এমন হওয়ার কারণে তারা সুযোগ পাচ্ছেন। তবে রয়টার্স এই দাবি নিশ্চিত করতে পারেনি।
ব্রাজিলের গ্রিন পার্টির সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং ব্রাজিল ক্লাইমেট সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক অ্যালফ্রেডো সিরকিস বলেন, ‘উষ্কানি দেওয়া ছাড়াও বোলসোনারো কৌশলে পরিবেশ সুরক্ষায় নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় অঙ্গকে অকার্যকর করে ফেলেছেন।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!