আজ সাঁথিয়ার ধুলাউড়ি গণহত্যা দিবস

জালাল উদ্দিন,  সাঁথিয়া (পাবনা) : আজ ২৭ শে নভেম্বর সেই ভয়াল ধুলাউড়ি হত্যাযজ্ঞের দিন। সারাদেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় দু’শ মুক্তিযোদ্ধা এসে অবস্থান নিয়েছে সাঁথিয়া থানার ধুলাউড়ি গ্রামে। একই গ্রামে সকলের অবস্থান করা নিরাপদ নয় ভেবে মুক্তিযোদ্ধারা ভাগাভাগি করে পার্শবর্তী বিলসলঙ্গী,রামকান্তপুর,পাইকশা,নাড়িয়াগদাই প্রভৃতি গ্রামে রাত যাপনের ব্যবস্থা করে। এদিকে দীর্ঘ কয়েক মাস দেশের বিভিন্নস্থানে একটানা যুদ্ধ করে সবাই ক্লান্ত-শ্রান্ত।

সাঁথিয়া থানা সদর থেকে প্রায় ৮/১০ কিলোমিটার ভেতরে জায়গাটি তাদের ধারনায় কিছুটা নিরাপদ মনে হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল রাত পোহালে পরবর্তী আক্রমনের জন্য সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি নেবে। এদিকে কিছুদিন আগে ( ১৯৭১ সেপ্টেম্বর মাসে) মুক্তিযোদ্ধারা সাঁথিয়া হাইস্কুলে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমন করে ৯ জন রাজাকার হত্যা করে এবং অস্ত্রলুট করে নেয়। মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক রাজাকার হত্যা ও অস্ত্রলুট হওয়ায় দালালরা খুবই তৎপর ছিল ও পাকসেনারাও সাঁথিয়ার ওপর নজর রাখছিল।

২৭ শে নভেম্বর। রাত আনুমানিক ৩ টা। চারদিকে গা ছমছম করা থমথমে ভাব, ভুতুরে নিরবতা। দূরে কুকুরের করুণ সুরের গোংড়ানি যেন অশুভ ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ গুলির শব্দ। দালালের সহায়তায় পাঁচশ পাকসেনা খুবই কৌশলে ধুলাউড়ি গ্রাম ঘিরে ফেলেছে। কথিত আছে পার্শ্ববতী বেড়া থানার জোড়দহ গ্রামের আসাদ নামের জনৈক দালাল ছিল এই নির্মম হত্যা কান্ডের পথ প্রদর্শক । ডিউটিরত মুক্তিযোদ্ধারা সময় মত তাদের সহযোদ্ধা বা গ্রামবাসীকে সতর্ক করার কোন সুযোগ পায়নি। ভোররাত থেকে শুরু হয় পাকসেনাদের তান্ডব লীলা। একাধারে চলতে থাকে হত্যা, লুটপাট, ধর্ষন ও অগ্নি সংযোগ। অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধা ও ঘুমন্ত গ্রামবাসী হতবিহবল হয়ে প্রান ভয়ে দিক বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। পাকসেনারা বাড়ি বাড়ি থেকে যুবতী মেয়েদের ধরে একটি বড় আম গাছের নিচে নিয়ে এসে উপর্যুপরি ধর্ষণ ক’রে গা থেকে গহনাপত্র খুলে নিয়ে লাথি মেরে পাশ্ববর্তী খালে ফেলে দেয়। মুক্তিযোদ্ধা ও বহু গ্রামবাসীকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে ঘুমন্ত অবস্থায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে। রশি দিয়ে একত্রে বেঁধে ইছামতি নদীর পাড়ে নিয়ে এসে ব্রাশ ফায়ারে নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। ওইদিনের হত্যাকান্ডে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা সহ ১৯ জন গ্রামবাসীর লাশ সনাক্ত করা যায়। এরা হচ্ছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা খবির উদ্দিন(পদ্মবিলা), আখতার হোসেন(ইসলামপুর ),দ্বারা হোসেন( রঘুনাথপুর), চাঁদ বিশ্বাস ( রঘুনাথপুর), মহসীন আলী ( কাজিপুর), শাহজাহান আলী ( চরতাঁরাপুর), মকছেদ আলী (বামুনডাঙ্গা), মুসলিম উদ্দিন ( চরতাঁরাপুর)। হত্যার শিকার গ্রামবাসীরা হচ্ছেন, আবুল কাশেম ফকির , ডাঃ আঃ আওয়াল, জহুরুল ইসলাম ফকির, আঃ রশিদ ফকির, আঃ গফুর, আঃ সামাদ বান্যে, নইম উদ্দিন খলিফা, ওয়াজেদ আলী, কোবাদ বিশ্বাস, আখতার হোসেন তালুকদার, মাহখনবি প্রমুখ।

সে দিন পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হওয়া ৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের গাঁয়ের চাঁদর দিয়ে জড়িয়ে কোন মতে ধুলাউড়ি ফকির পাড়া প্রাইমারী স্কুলের সামনে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়। আরও রাখা হয় ব্রাশ ফায়ারে নিহত ১০/১১জন গ্রামবাসীকে । সেটি এখন গনকবর হিসাবে পরিচিত।

সে দিনের ব্রাশ ফায়ারে বেঁচে যাওয়া শাহজাহান ( পাকসেনারা বেয়নেট দিয়ে যার গলা কেটে দিয়েছিল) মৃতুর আগ পর্যন্ত গলাকাটা শাহজাহান হিসেবে পরিচিত ছিল। ”৭১এ ধুলাউড়ির সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞ এখনো সাঁথিয়াবাসীর কাছে দুঃখ ও বেদনার স্মৃতি হয়ে আছে। তাদের দাবী ধুলাউড়ির শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মান করা হোক। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও দিবসটি যথাযথভাবে পালনের উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!