আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের ৪৩ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে স্মৃতিকথা
। আমিরুল ইসলাম রাঙা।
আজ আটঘরিয়া প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার ৪৩ বছর পূর্তি হলো। ১৯৭৮ সালের ৭ মে আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠিত হয়। সেদিন কিছু উদীয়মান তরুণ এবং যুবকের অদম্য উৎসাহকে পুঁজি করে এই প্রেসক্লাবটির যাত্রা শুরু হয়। সাংবাদিকতায় নবীন হলেও সংবাদপত্রের পাঠক, গল্প-কবিতার লেখক, সমাজকর্মী ও সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে তাঁদের যথেষ্ট পরিচিতি ছিল। সেদিন মুক্তিযুদ্ধের সৈনিকেরা হয়েছিলেন কলম যোদ্ধা। এরপর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শানিত কয়েকজন মিলিত হয়ে আটঘরিয়া প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার বীজ রোপন করেন।
পাবনা জেলার সবচাইতে অনুন্নত এবং অবহেলিত এই থানার অবকাঠামোর চিত্র ছিল খুবই করুণ। আটঘরিয়া এলাকায় পুলিশ স্টেশন, হাসপাতাল, কলেজ ও স্কুলের সাথে ছোট একটি বাজার ছিল। আর দেবোত্তর এলাকায় থানা কাউন্সিল অফিস এবং একটি বাজার ছিল। আটঘরিয়া এবং দেবোত্তরে সপ্তাহে দুইদিন করে হাট বসতো। দোকান-পাট ছিল হাতে গোনা। গোটা থানায় পেপার পড়ার মানুষ ছিল খুবই কম। এমন একটি থানায় প্রেসক্লাব গঠনের ঘোষণায় বিশেষ বিশেষ কেউ আঁতকে উঠেছিলেন। আটঘরিয়া প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার ঘোষণায় সংবাদপত্র এবং সাংবাদিক মহলকেও অবাক এবং হতবাক করেছিল।
আটঘরিয়া প্রেসক্লাব পাবনা জেলার মধ্যে তৃতীয় প্রেসক্লাব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৬১ সালের ১ মে ৩ জন সাংবাদিক মিলিত হয়ে পাবনা প্রেসক্লাব গঠন করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে ঈশ্বরদী প্রেসক্লাব দ্বিতীয় প্রেসক্লাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৭৮ সালে আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠন করা হয়। পাবনা প্রেসক্লাব গঠনের ১৭ বছর পর এই মে মাসের ৭ তারিখে ৬ জন সাংবাদিক নিয়ে আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠন করা হয় এবং জেলার তৃতীয় প্রেসক্লাব হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
এই গৌরবের সাথে আমার অর্জন হলো, সেদিন আমার উদ্যোগে ও আমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠন করা হয়েছিল। এই অর্জনের সাথে আটঘরিয়ার সন্তান হিসেবে আমার আরেকটি মাইফলক যোগ হয় তাহলো ঐ অঞ্চলে আমিই প্রথম সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করি। প্রসঙ্গ উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে আমার সম্পাদনায় পাবনা শহর থেকে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ইছামতি। যদিও সাংবাদিক বিষয়ে আমার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। বলা যায় পত্রিকার সম্পাদক হয়ে সাংবাদিকতার শুরু। তখন সম্পাদনার পাশাপাশি ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক গনকন্ঠের পাবনা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করি।
১৯৭২ সালের জুন/জুলাই মাসে রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে আমার সম্পাদিত সাপ্তাহিক ইছামতি বন্ধ হয়ে যায়। তখন গনকন্ঠের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতাম। ১৯৭৩ সালে মার্চ মাসে রাজনৈতিক কারণে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হয়। কারাবন্দী সময়কালে দৈনিক পত্রিকা নিয়মিত পড়তাম । ১৯৭৪ সালে আমাকে দিনাজপুর জেলখানায় বদলি করা হলে সেখানে পত্রিকা পড়ার সাথে স্থানীয় দৈনিক উত্তরা পত্রিকায় নামে-বেনামে উপসম্পাদকীয় লিখতাম। ১৯৭৫ সালে শেষদিকে কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করি। তখন দেশে সামরিক শাসনের কারণে রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। সংবাদপত্র কঠোরভাবে সরকার নিয়ন্ত্রিত ছিল।
১৯৭৭ সালে শেষদিকে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক দেশবাংলা এবং দৈনিক বাংলার মুখ পত্রিকায় পাবনা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করি। ১৯৭৮ সালে প্রথম দিকে কয়েকটি মফঃস্বল পত্রিকায় আটঘরিয়া প্রতিনিধি হিসেবে সংবাদ প্রেরণ করলে আটঘরিয়া ডেট লাইনে সংবাদ প্রকাশ হতে থাকে। তখন থেকে মনের মধ্যে স্বপ্ন দেখতে থাকি আটঘরিয়ায় প্রেসক্লাব গঠন করার। আর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাকে প্রচন্ড ভাবে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন, পাবনা প্রেসক্লাবের সদস্য প্রয়াত সাংবাদিক আ,জ,ম আব্দুল আউয়াল খান। যিনি পাবনার সুপরিচিত সাংবাদিক রবিউল ইসলাম রবি ভাইয়ের ভগ্নিপতি এবং সাংবাদিক আব্দুল মতিন খানের বড় ভাই। আটঘরিয়া প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠায় যার অবদান ছিল অপরিসীম।
আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠনের লক্ষ্যে ঐ অঞ্চলে সাংস্কৃতিকমনা অনেককে সাংবাদিক হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতে থাকলাম। এরমধ্যে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আটঘরিয়া সফরে আসার দিন ধার্য্য হয়। আমার ভাবনা ছিল, তাঁর সফরের আগে আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠন করে ঐ সমাবেশে ব্যানার সহ উপস্থিত থাকলে ব্যাপক প্রচার হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। সেই লক্ষ্যে ৭মে আমার আহবানে এবং আমার সভাপতিত্বে দেবোত্তর বাজারে একটি সভা করা হয়। সেই সভায় আলোচনা শেষে আমার প্রস্তাব অনুযায়ী মোঃ এবাদত আলীকে সভাপতি এবং আব্দুস সাত্তার মিয়াকে সাধারন সম্পাদক করা হয়। সদস্য করা হয়, মোহাম্মদ ইয়াছিন, মোঃ হাসান আলী, সিরাজুদ দাহার মাতলু এবং আমি। বলা যায় ঐদিনই যোগ হয় এইচ,কে,এম আবু বকর সিদ্দিক। আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠনের ঘোষণায় আমরা প্রত্যাশার চাইতে বেশি সফল হয়েছিলাম। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার সংবাদ ফলাও করে প্রকাশ হয়েছিল। সংবাদপত্র এবং পাবনার সিনিয়র সাংবাদিকবৃন্দ আমাদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায়।
যথারীতি আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠনের পর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জনসভায় আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের ব্যানার নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম। সেদিন সভায় উপস্থিত সবাই আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের অস্তিত্ব অবলোকন করেন। পরবর্তীতে সাংবাদিক হিসেবে আমাদের আত্মপ্রকাশ আটঘরিয়ার মানুষের কাছে দিন দিন আস্থা এবং বিশ্বাসের স্থান অর্জন করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিক নিয়োগ হতে থাকে। ক্রমেই সংবাদকর্মী বৃদ্ধি হয় । সাথে সাথে পত্রিকার এজেন্ট, হকার এবং পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকে। বলা যায় প্রতিষ্ঠার প্রথম দশক ছিল আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের স্বর্ণযুগ। যা আজ আমার কাছে সোনালী অতীত। এমন একটি সংগঠনের ৪৩ বছর পূর্তি – আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া। এই সময়কালে একসাথে চলতে গিয়ে ভালো-মন্দ সবকিছু মোকাবেলা করতে হয়েছে। আজকের এইদিনে মন্দ বিষয়গুলি বাদ দিয়ে বলতে চাই, আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের অতীত ও বর্তমানের অর্জন ঐতিহ্যের এবং গৌরবের।
আজ ৪৩ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি প্রয়াত সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল্লাহ, সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস খান এবং সাংবাদিক রুস্তম আলীকে। উনারা আমাদের ছেড়ে এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। উনাদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। আজ ৪৩ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে পরম করুনাময়ের কাছে শোকরিয়া আদায় করছি, এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য যথাক্রমে এবাদত আলী, আব্দুস সাত্তার মিয়া, মোহাম্মদ ইয়াসিন, মোঃ হাসান আলী, সিরাজুদ দাহার মাতলু এবং আমি এখনো বেঁচে আছি। আটঘরিয়া প্রেসক্লাবে গত ৪৩ বছর একসাথে পথচলা সাংবাদিক এবাদত আলী, মোঃ আব্দুস সাত্তার মিয়া, এইচ,কে,এম আবু বকর সিদ্দিক, মোহাম্মদ ইয়াসিন, সিরাজুদ দাহার মাতলু, মোঃ হাসান আলী, অধ্যাপক আব্দুল গফুর মিয়া, এডভোকেট আতাউর রহমান চৌধুরী, এডভোকেট সানোয়ার হোসেন, মোঃ তৈয়াব আলী, আব্দুস সামাদ আজাদ, আবুল হোসেন, আব্দুল কুদ্দুস সাগর, চৌধুরী আব্দুস ছাত্তার, প্রভাষক আমজাদ হোসেন, প্রভাষক মোবারক হোসেন, খাইরুল ইসলাম বাসিদ, মাসুদ রানা, মোফাজ্জল হোসেন বাবু,জিল্লুর রহমান রানা, আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী, রইস উদ্দিন রবি, মোসলেম উদ্দিন, ফজলুর রহমান খান, জিল্লুর রহমান ডিলু, নুরুল ইসলাম খান, আনারুল ইসলাম, মাওলানা আমিরুল ইসলাম, মোঃ শফিউল্লাহ, আব্দুল মাজেদ প্রিন্স, রবিউল ইসলাম শাহীন, শফিউল্লাহ শফি, শফিকুল ইসলাম মিঠু, শহিদুল ইসলাম, আক্কাস আলী,আব্দুস সবুর, রবিউল ইসলাম রবি সহ নতুন প্রজন্মের অনেক নতুন মুখ আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের সাথে জড়িত আছেন তাঁদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি । আজকের এই বিশেষ দিনে সবাইকে শুভেচ্ছা, শুভ কামনা এবং ভালবাসা জানাচ্ছি। বর্তমান সভাপতি খায়রুল ইসলাম বাসিদ এবং সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান রানাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। পরিশেষে প্রত্যাশা করছি ৪৩ বছরের এই সংগঠনটি যেন – শত শত বছর সগৌরবে এগিয়ে যায়। ( সমাপ্ত)
লেখক,
আমিরুল ইসলাম রাঙা
প্রতিষ্ঠাতা ও আজীবন সদস্য
আটঘরিয়া প্রেসক্লাব, পাবনা।
৭ মে ২০২১