আরটিভি স্টার এ্যাওয়ার্ড পেলেন নাট্য ব্যাক্তিত্ব আব্দুল হান্নান শেলী
পিপ (পাবনা) : আরটিভি স্টার এ্যাওয়ার্ড পেলেন নাট্য ব্যাক্তিত্ব পাবনার সন্তান অ্যাডভোকেট আব্দুল হান্নান শেলী। সুমন আনোয়ার রচিত ও পরিচালিত নাটক “নিখোঁজ হওয়া ভাষা সৈনিক” নাটক থেকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে তাকে মনোনীত করা হয় আরটিভি স্টার এ্যাওয়ার্ড-২০২০ এর জন্য।
এই দিয়ে তিনি দ্বিতীয়বার লাভ করলেন এ পুরস্কার। পাবনা শহরের রাধানগর মহল্লার মরহুম আবু তাহের আনসারী ও হোসনে আরা শেফালীর ছেলে আব্দুল হান্নান মোস্তফা বিন তাহির শেলী। তিনি অভিনয় জগতসহ নানা পরিসরে আব্দুল হান্নান শেলী নামে পরিচিত। অত্যন্ত সদালাপী ও পরোপকারী নাট্যজন শেলী ১৯৭৩ সালে কল্যাণ মিত্রের লেখা মঞ্চ নাটক “সাগর সেচা মানিক” এ অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু তার।
পরবর্তিতে আরো কয়েকটি নাটক করা পর ১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে পরপর দুবার ঢাকার শিল্পকলা একাডেমি মঞ্চে যথাক্রমে পাবনার মঞ্চপরাগ ও ইফার প্রযোজনায় শওকত ওসমান রচিত ক্রীতদাসের হাসি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাস্তি নাটকে প্রথম ও দ্বিতীয় জাতীয় নাট্য উৎসবে অভিনয় করেন। এরপরে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। সেখানে পড়ালেখার পাশাপাশি চালিয়ে যান অভিনয় চর্চা, ১৯৭৯ সালে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তারই নেতৃত্বে গড়ে তোলেন অনুশীলন নাট্যদল। পরের বছর ১৯৮০ সালে আব্দুল হান্নান শেলীর নেতৃত্বে পাবনা শহরে অনুশীলন আশি নামের একটি নাট্য সংগঠন গড়ে ওঠে,যার মূল নেতৃত্ব দেন তিনি নিজেই,দায়িত্ব পালন করেন নাট্য পরিচালনার। আশির দশকের মাঝামাঝিতে পাবনাতে মহিলা নাট্যকর্মীর একরকম ছিলোই না বললেই চলে, নাটক মঞ্চায়ন করতে গেলে বাইরের জেলা থেকে পেশাদার মহিলা নাট্যকর্মী টাকার বিনিময়ে অভিনয়ের জন্য পারিশ্রমিক দিয়ে আনতে হয়। তখন নিজের আপন দুটি বোনকে দিয়ে শুরু করেন নাটকের কাজ। নিজের দুই বোনকে সাথে নিয়ে ক্ষতবিক্ষত, ইবলিশ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কাঁকলাশ, এই দেশে এই বেশে, সাত ঘাটের কানাকড়ি প্রভৃতি নাটকে অভিনয় করেন।
পরবর্তিতে অন্য নাট্য সংগঠনগুলো মহিলা নাট্যকর্মী সংগ্রহ শুরু করে। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ালেখার সময়ে রাজশাহী সাংস্কৃতিক সংঘ (পদ্মামঞ্চ) এর সদস্য হয়ে তাদের প্রযোজিত নাটকে অভিনয় করেন আব্দুল হান্নান শেলী। ১৯৯০ সালের পরে নিজের উদ্যোগে ঢাকা থেকে রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশিদ, আবু জাফর সিদ্দিকি, রহমত আলী, দিপু আহমেদ, সামসুল আলম বকুল, মাসুম রেজাদের মতো নাট্যজনদের পাবনা নিয়ে এসে পাবনার নাটকের মান উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মেয়াদে নাট্য কর্মশালার আয়োজন করেন তিনি। আশির দশকে দেশের প্রখ্যাত নাট্যকার নির্দেশক মামুনুর রশিদের মুক্ত নাট্যদলের পাবনা জেলার আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। আব্দুল হান্নান শেলীর পরিচালিত এবং অভিনিত নাটকগুলোর মাঝে ইবলিশ, ক্ষতবিক্ষত, এই দেশে এই বেশে, ঘড়লোপাট, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন নাট্য উৎসবে অংশগ্রহন করে মান নির্ণয়ের দিক থেকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। আব্দুল হান্নান শেলীর হাতে তৈরি করা বেশ কয়েকজন নাট্যকর্মী ভালো নাটক ও অভিনয় করার সুবাদে স্কয়ার ট্রয়লেট্রিজ গ্রুপে চাকরি পেয়েছেন। সেখানে গিয়ে তারাও গড়ে তুলেছেন স্কয়ার নাট্য গ্রুপ। পাবনাতে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠনের সময়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং ১৯৯০ সাল ও ১৯৯১ সালে সম্মিলিত সাংস্কৃতি জোটের পাবনা জেলা আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল হান্নান শেলী।
১৯৯৫ সালে ঢাকাতে গিয়ে সেখানে দেশ নাটকের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে সেখানেও মঞ্চ নাটক করেন তিনি। পরবর্তিতে ২০০১ সালে পাবনা ফিরে এসে অনুশীলন আশির সাথে কাজ করেন। এর মাঝে জেলার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন বনমালী ইনষ্টিটিউটের আজীবন সদস্য হন এবং সেখানকার কার্যকরি পরিষদের একাধিকবার যুগ্ন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করাসহ নাট্য পরিচালনা ও অভিনয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চ, মহিলা সমিতি মঞ্চ, গাইড হাউজ মঞ্চ, ঢাকা কচিকাঁচার মেলা মঞ্চ, জার্মান কালচারাল সেন্টার মঞ্চসহ বিভিন্ন মঞ্চে অভিনয় করেন তিনি। এছাড়াও রাজশাহী, কুষ্টিয়া, ভেড়ামারা, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর, নাটোর, নওগাসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার মঞ্চে অভিনয় করেন তিনি।
১৯৮৮ সালে বন্যাকবলিত মানুষদের জন্য এডওয়ার্ড কলেজের আব্দুস সাত্তার মিলনায়তনে ৬ দিনব্যাপী দর্শনীয় বিনিময়ে নাট্য উৎসবের আয়োজন করে সেখান থেকে উপার্জিত অর্থ অনুশীলন আশি নাট্যদলের ব্যানারে নাট্যকর্মীদের সাথে নিয়ে বর্নাত্যদের মাঝে বিতরণ করেন। আব্দুল হান্নান শেলী পরিচালিত পথনাটকগুলো হলো- যদি আমরা সবাই, ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাচাল, বাসন, সাদা বেনিয়ার কালো আইন, পোষ্টার, ফেরারি নীশান, কাঁকলাশ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, আওরঙ্গজেব, লোভ প্রভৃতি। তার অভিনিত মঞ্চ নাটকগুলো হলো- এখন দু:সময়, এখনও ক্রীতদাস, এবার ধরা দাও, ওরা কদম আলী, শাস্তি, ইবলিশ, সাত পুরুষের ঋণ, ক্ষতবিক্ষত, এই দেশে এই বেশে, সাত ঘাটের কানাকড়ি, ঘড়লোপাট, দর্পনে শরৎশশী, শবব্যবচ্ছেদ, শতগ্রন্থি প্রভৃতি।
টেলিভিশনে তার অভিনিত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো- রমিজের আয়না, দি নিউ সবুজ অপেরা, শঙ্খবাস, নিসর্গ, মামুলি একটা মানুষ, ইট কাঠের খাঁচা, উৎসব, ঘোড়ার ডিম, বাতিঘড়, কাক ডাকা ভোর, যুগলবন্দি, বাঘাশের, সবুজ গ্রামে নীল ডিস এন্টিনা, ঠিকানা জানা নেই, টোটো কোম্পানী, চুককথা, ওয়ারিশ, সংসার সিমান্তে প্রভৃতি। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র অভিনয়ের মাঝে রয়েছে- কিত্তন খোলা ও জীবন ঢুলি।
তিনি শতাধিক একক নাটকে অভিনয় করেছেন, টেলিফিল্মে অভিনয় করেছেন অসংখ্যবার অসংখ্য চরিত্রে। নাটকপাড়াতে আব্দুল হান্নান শেলীর একটা শক্ত অবস্থান রয়েছে, ভক্ত অনুসারীদের অনেক ভালোবাসায় সিক্ত এই মানুষটি তার পেশাগত বারান্দাতেও জয় করেছেন সহকর্মীদের।
আর একারনে পাবনা জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে যুগ্ন সম্পাদক (সংস্কৃতি), ট্রেজারার ও সহ সভাপতি পদে নির্বাচিত হন তিনি। বনমালী ও রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির আজীবন সদস্য আব্দুল হান্নান শেলী নাটক টেলিফ্লিম, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র সব মিলিয়ে এক হাজারেরও বেশি জায়গাতে অভিনয়ের মাধ্যমে সম্পৃক্ত করেছেন নিজেকে। নাটককে অনেক বেশি ভালোবাসেন আব্দুল হান্নান শেলী, আর একারনে কোন দিকে না তাকিয়ে তার বড় ছেলেকে শখ করে ভর্তি করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও নাট্যতত্বের ছাত্র হিসেবে।
তার সেই ছেলেও সেখান থেকে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করে মাষ্টারস সম্পন্ন করেছে এবং বর্তমানে নাটকের ওপরে সে পিএইচডি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আব্দুল হান্নান শেলীর স্ত্রী হোসনে আরা কনা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা, স্বামীকে উৎসাহ দেন। স্বামীর অভিনয়ে টিভিতে দেখে মুগ্ধ হন বেশ, তার অনুপ্রেরণা এগিয়ে দিয়েছে নাট্যব্যাক্তিত্ব শেলীকে। ইতোমধ্যেই দেশের নাট্যপ্রিয়দের কাছে এক প্রিয় নাম শেলী, প্রিয়মুখ শেলী।
নিজেকে দর্শকমুগ্ধ করে গড়ে তুলতে সামর্থ্য হয়েছেন তিনি। আরটিভির স্টার এ্যাওয়ার্ড-২০২০ লাভ করে তিনি তার অনুভুতিতে বলেন, এটা পাবনাবাসীর জয়। এই পুরস্কারটি আসলে পাবনার মানুষ পেয়েছে।
সকলকে নিজ নিজ পরিসর থেকে পাবনাকে এগিয়ে নেবার জন্য সকলের প্রতি বীনিত অনুরোধ জানান তিনি ও সকলে কাছে নিজের জন্য দোয়া প্রার্থনা করেন তিনি। উল্লেখ্য, নাট্যব্যাক্তিত্ব আব্দুল হান্নান শেলী পাবনা-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, বীরমুক্তিযোদ্ধা, পাবনার প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনকারী জননেতা মরহুম রফিকুল ইসলাম বকুলের শ্যালক।