ইসলামী শরিয়ত কী ও কেন

ধর্মপাতা: মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম: শরিয়ত শব্দটি আরবি। এর মূলধাতু শারউন। আভিধানিক অর্থ আইন, বিধান, পন্থা, পদ্ধতি ইত্যাদি। পরিভাষায় শরিয়ত বলা হয় এমন এক সুদৃঢ় ঋজু পথকে, যে পথে চললে লোকেরা হেদায়াত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মপন্থা লাভ করতে পারে। ইসলামি আইনবিদদের মতে, শরিয়ত বলতে বোঝায় সেসব আদেশ-নিষেধ ও পথনিদের্শ, যা আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি জারি করেছেন। এর উদ্দেশ্য হলো, লোকেরা তাঁর প্রতি ইমান এনে ঈমানের দাবি অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করবে।

নবী-রাসুলের ভিন্ন ভিন্ন শরিয়ত : শরিয়ত সর্বপ্রথম প্রবর্তিত হয় নুহ (আ.)-এর প্রতি। তাঁর পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের কোনো শরিয়ত ছিল না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য দ্বিনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নুহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইবরাহিম, মুসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে তোমরা দ্বিনকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং অনৈক্য সৃষ্টি করো না।’ (সুরা শুরা, আয়াত : ১৩)

সব নবী-রাসুলের শরিয়ত এক ধরনের ছিল না। শরিয়তপ্রণীত হয় উম্মতের অবস্থা, মানসিকতা, চিন্তা-চেতনা ইত্যাদি দিক বিবেচনা করে। ফলে একেক নবী-রাসুলের শরিয়ত একেক ধরনের ছিল। ইসলামি শরিয়ত মধ্যপন্থী ও ভারসাম্যপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা সুষ্ঠু, সুন্দর, পরিমার্জিত ও উন্নত জীবন পরিচালনার জন্য শেষ নবীর উম্মতকে উপহার দিয়েছেন এক উন্নতর জীবন-দর্শন।

শরিয়তের উদ্দেশ্য : সব কিছুরই একটা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। এ হিসেবে ইসলামি শরিয়তের উদ্দেশ্য হলো

১. দ্বিন রক্ষা করা : আল্লাহ তাআলার একমাত্র মনোনীত দ্বিন হলো ইসলাম। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘নিঃসন্দেহে ইসলামই আল্লাহর একমাত্র মনোনীত দ্বিন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৯)দ্বিন গ্রহণের পরও শয়তানের প্ররোচনায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইসলামি শরিয়ত বিধান দিয়ে এর শাস্তি নিশ্চিত করে দ্বিন রক্ষা করেছে।

২. জীবন রক্ষা : আল্লাহ তাআলা মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন নেতৃত্বদানকারী হিসেবে। তাদের আবাসস্থল হলো এই বিশাল পৃথিবী। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি তো আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি। তাদের দান করেছি উত্তম রিজিক এবং আমি যাদেরকে সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।’ (সুরা আল ইসরা, আয়াত : ৭০) মানবমর্যাদা রক্ষায় ইসলামি শরিয়ত অন্যায়ভাবে মানবহত্যা হারাম ঘোষণা করেছে এবং এর শাস্তির বিধান দিয়েছে।

৩. বংশ রক্ষা করা : মানুষের বংশ বিস্তারের জন্য শরিয়ত বিবাহের ব্যবস্থা করেছে। বিবাহের ফলে আল্লাহর ইচ্ছায় পৃথিবীতে সন্তান আসে। সন্তানের মাধ্যমে বংশধারা প্রতিষ্ঠিত হয়। অবৈধ পন্থায় যৌনকার্য করার ফলে যে সন্তান আসে তাতে বংশধারা চালু থাকে না। তাই শরিয়ত একে হারাম ঘোষণা করেছে এবং এ কাজ যারা করবে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করেছে।

৪. সম্পদ রক্ষা করা : সম্পদ মানুষের অতীব প্রয়োজনীয় বস্তু। সম্পদ অর্জনের পন্থা দুটি। একটি বৈধ পন্থা আরেকটি অবৈধ পন্থা। শরিয়ত অবৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জন করাকে হারাম ঘোষণা করেছে এবং শাস্তির বিধান নিশ্চিত করেছে। যাতে এক শ্রেণির মানুষের কাছে সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে থাকে। আল্লাহর বাণী ‘…সম্পদ যেন শুধু তোমাদের ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়।’ (সুরা হাশর, আয়াত : ৭)

৫. মানবিক মর্যাদা রক্ষা : মানুষের মান-সম্মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই ইসলামি শরিয়ত মানুষের মান-সম্মানের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আল্লাহ তাআলা সুরা হুজরাতের ১১ ও ১২ নং আয়াতে ছয়টি বিষয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ছয়টি বিষয় হলো ক. উপহাস না করা, খ. দোষারোপ না করা গ. মন্দ নামে না ডাকা, ঘ. অমূলক ধারণা বর্জন করা, ঙ. গোপন দোষ প্রকাশ না করা চ. গিবত না করা।

৬. মানবাধিকার রক্ষা করা : ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম। তাই ইসলামি শরিয়ত মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, বিচারব্যবস্থাসহ জীবনের সব বিভাগে উদ্ভূত সমস্যাদি সমাধানে ব্যবস্থা নিয়েছে। মানুষের যেসব ক্ষেত্রে অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়, ইসলামি শরিয়ত সেসব ক্ষেত্রে অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করেছে।

৭. পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করা : ইসলামি শরিয়ত আদম সন্তান হিসেবে ভেদাভেদ দূর করে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছে। ফলে ইসলামি শরিয়ত ব্যক্তি স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মানবতাবোধ নিশ্চিত করেছে। মহানবী (সা.) মদিনা সনদ ও হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে তা দেখিয়ে দিয়েছেন।

৮. মানব জীবনকে গতিশীল করা : গতিশীল জীবন লাভের জন্য প্রয়োজন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগানো। মানব জীবন কর্ম দ্বারাই জীবন্ত, গতিশীল ও প্রাণবন্ত হয়। ধর্মই মানুষকে গতিশীল ও কর্মময় করে। জীবনকে গতিশীল করার জন্য তিনটি গুণ আবশ্যক। তা হলো, সংকল্প, ধৈর্য ও সততা। ইসলামি শরিয়ত ব্যক্তির মধ্যে এসব গুণাবলি লালন করে।

৯. মানবিক গুণাবলি বৃদ্ধি করা : ইসলামি শরিয়তের বিশেষ উদ্দেশ্য হলো মানুষের মানবিক গুণাবলি বৃদ্ধি করা। আর তা হলো, তাকওয়া, সততা, বিনয়-ন¤্রতা, ধৈর্য-সহিষ্ণুতা, দানশীলতা, আমানতদারি, ন্যায়পরায়ণতা, কর্তব্যপরায়ণতা ইত্যাদি।

১০. অন্যায় বন্ধ করা : অন্যায় হলো ন্যায়ের বিপরীত। ইসলাম ন্যায়ের পক্ষে, অন্যায়ের বিপক্ষে। ইসলাম সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার ও অসৎ কার্যকলাপ দূর করতে চায়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে, তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দাও, অসৎ কাজে নিষেধ করো এবং আল্লাহকে বিশ্বাস করো’ (সুরা আলে ইমরান : ১১০)

লেখক : প্রধান ফকিহ, আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!