উত্তরের জনপদ তীব্র শীত ; দুর্ভোগে নিম্ন আয়ের মানুষ
রাজশাহী : গত এক সপ্তাহ ধরে রাজশাহীতে পড়ছে তীব্র শীত। হু হু করে বয়ে যাওয়া ঠান্ডা বাতাশে জুবুথুবু হয়ে পড়েছেন এই এলাকার মানুষ। হিমালয় ছুঁয়ে আসা কনকনে ঠা-া বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে উত্তর জনপদের ছিন্নমূল মানুষকে। প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্রের অভাবে বেশ দুর্বিষহ দিন পার করছেন অনেকেই। সবচাইতে বেশি সমস্যার মধ্যে পড়েছেন নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া ও ছিন্নমূলরা। এ শৈত্য প্রবাহের কারণে মানুষের মাঝে বিভিন্ন রোগ দেখা দিয়েছে। ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্তরা হাসপাতাল ও বিভিন্ন ক্লিনিকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে এবার শীতের শুরু থেকেই রাজশাহী অঞ্চলের শিশুদের মধ্যে ঠান্ডাজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা দিয়েছে। বাদ যাচ্ছে না বৃদ্ধরাও। গত কয়েকদিন থেকে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি হতে দেখা যাচ্ছে। ভর্তি রোগীদের মধ্যে প্রায় সবাই পেটের পীড়া, আমাশয়, সর্দি-কাশি, জ¦র ও বয়স্কদের অধিকাংশই হৃদরোগ আক্রান্ত রয়েছে। আর শিশুদের মধ্যে অধিকাংশই ডায়রিয়া, জ¦র এবং নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত।
এদিকে শীত বাড়ার সাথে সাথে দুর্ভোগ বাড়ছে ছিন্নমূল সাধারণ দিনমজুর শ্রেণীর মানুষের। তীব্র শীতের জন্য লোকজন কাজ করতে পারছেন না। সকাল হলে কাজে বের হওয়ার পরিবর্তে খড়কুটা জ¦ালিয়ে শীত নিবারণ করছেন। একই অবস্থা বিরাজ করছে গ্রামাঞ্চলের মানুষের। অতি প্রয়োজন ছাড়া লোকজন বাইরে বের হচ্ছেন না। গ্রামাঞ্চলের লোকজন হাটবাজারে না গিয়ে শীত নিবারণের জন্য ছুটছে বাড়ির পাশে চায়ের স্টলের দিকে। গ্রামাঞ্চলে উচ্চ শ্রেণীর মানুষের তেমন দুর্ভোগ না হলেও খেটে খাওয়া লোকজনদের দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে।
রাজশাহী আবহাওয়া অধিদফতরের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক আনোয়ারা বেগম মুঠোফোনের মাধ্যমে সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে জানান, রোববার হঠাৎ তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি থেকে ৫ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। যেটি চলতি মৌসুমে রাজশাহীর সর্বনি¤œ তাপমাত্রা হিসেবে রেকর্ড হয়েছে। তবে আজ সকালে সেই তাপমাত্রা সামান্য বেড়ে ৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠেছে। আর বর্তমানে রাজশাহীর ওপর দিয়ে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে বলেও জানিয়েছেন এই আবহাওয়া পর্যবেক্ষক।
রামেক হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আজিজুল হক জানান, ‘শীত বেড়ে যাওয়ায় সব বয়সের মানুষ ঠা-া জনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। হাসপাতালে ঠা-া জনিত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। এসব রোগীর মধ্যে শিশু ও বয়স্কদের সংখ্যাই বেশি।’
এদিকে গরম পোশাকের অভাবে কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন রাজশাহীর ছিন্নমূল ও নি¤œ আয়ের মানুষ। শীত বাড়ার সাথে সাথে রাজশাহীর বাজারগুলোতে চলছে গরম কাপড় কেনাকাটার হিড়িক। শীত নিবারণে ছুটছেন গরম পোশাকের দোকানে। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে কিনছেন পোশাক। তবে এবার গরম কাপড়ের মার্কেটগুলোর চেয়ে ফুটপাতে লোকসমাগম বেশি। কম দামে শীতবস্ত্র নিতে গিয়ে সেখানেও সস্তি মিলছেনা। বিত্তবানরা দামী পোশাক কিনলেও সাধারণ খেটে খাওয়া ব্যক্তিরা গরম কাপড় কিনতে ভিড় জমাচ্ছেন ফুটপাতে। হতদরিদ্রের সাধ্যের মধ্যে মাত্র ২০ থেকে ৫০ টাকাতে এসব ফুটপাতে মিলছে গরম কাপড়। যে দামের মধ্যে শুয়েটার, টুপি, মাপলার, চিকন জ্যাকেট ও ফুলহাতা গেঞ্জি। এমন সস্তায় শীতের পোশাক পেয়ে খুশি এসব ক্রেতারা। তবে ১শ’ থেকে দেড়শ’ টাকার মধ্যে মানসম্মত অনেক ধরণের পোশাক ফুটপাতেও বিক্রি করা হচ্ছে। এসব পোশাক কতটুকু স্বাস্থ্য সম্মত তা অনুমান করলেই বোঝা যায়। কিন্তু নি¤œ আয়ের দিনমুজুররা স্বাস্থের বিষয়টি না ভেবেই তা ব্যবহার করছেন। এতে করে চর্ম রোগ হতে পারে বলেও ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। যে কারণে এসব পোশাক পরিধানের পূর্বে পানিতে জিবাণুনাশক এন্টিসেফটিক ব্যবহার করে তা ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন চিকিৎসকরা।
রাজশাহী মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র সাহেব বাজার, আদালত চত্তর, লক্ষীপুর, রেলগেট, বাসটার্মিনালসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে ফুটপাতের এসব দোকানিরা ক্রেতার ভিড় জমাতে দাম হাকছেন ‘মাত্র বিশ, বিশ (কুড়ি) বলে। এ কারণেই শুধু নি¤œ আয়েরই নয়, ফুটপাতের এসব পোষাকের দোকানে ভিড় করছেন কৌতুহলি বিভিন্ন শ্রেনীর পথচারীরাও। তবে কেউ কেউ আবার সেখান থেকে বেছে কিনছেন পছন্দের পোশাক।
এদিন সকালে রাজশাহীর আদালত চত্তরের ফুটপাত থেকে ক্রয় করা মধ্যবিত্ত এক ব্যক্তি পরিচয় গোপন রেখে বলেন, ‘বাড়ির কাজের লোকদের জন্য কিনলাম, ‘দাম কম হলেও কোয়ালিটি খুব খারাপ না। এ টাকায় আজকাল কি কোন পোশাক পাওয়া যায়?’
মমতাজ নামের এক আইনজীবী বলেন, ‘রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। এদের ডাকা হাঁকে দাঁড়ালাম। দুটি ফুল গেঞ্জি পছন্দ হওয়ায় কিনেও ফেললাম।’
ফুটপাত দোকানদার সাইফুল বললেন, ‘শীতের এসব পোশাক লট ধরে কেনা। গড় হিসাবে ৩ থেকে ৫টাকা লাভ রেখেই বিক্রি করছি। তাতেই সারাদিনে এক থেকে দেড় হাজার টাকা লাভ হয়। এখানে সাধারণত গরীবরাই বেশী আসে। তবে কখনো কখনো বড় লোকেরাও আসে, কিনে নিয়ে যায়, কিন্তু তারা কি করে তা জানিনা। তবে কেনার সময় একা একাই বলে বাড়ির কাজের লোকদের গায়ে ভালোই লাগবে।’
অন্যদিকে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নগরীর গরম পোশাকের দোকানগুলোতে ভিড় বেড়েছে। ছেলেরা জ্যাকেট ও শুয়েটার কিনলেও নারীরা চাদরের দোকানে বেশি ভিড় জমাচ্ছেন। তবে করোনা মহামারীতে আমদানি কম অজুহাতে সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীরা এবার শীতের কাপড়ের দাম অনেক বেশি নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ ক্রেতাদের।