এই গল্পের কোন শিরোনাম নেই
তাহসিনুল ইসলাম
মা কনে পছন্দ করলো না। কনের চেহারা কালো। সুন্দর বলতে আমরা উজ্জ্বল বর্ণ বুঝি। কালো মানেই অসুন্দর। সে হিসেবে কনে অসুন্দর।
আমি মাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, মা অদ্রি অনেক সুন্দর। সে তোমার সংস্পর্শে এলেই বুঝতে পারবে তার সত্যিকার সৌন্দর্য।
‘এই মেয়ের সাথে তোর কতোদিনের সম্পর্ক?’
‘পাঁচ বছরের।’
মা হতাশ হলো। বড় ভাইয়ের বিয়ের সময় মা আর বাবাকে একপ্রকার যুদ্ধ করতে হয়েছে। কনে বাছাই যুদ্ধ। কনে দেখতে যায়, পোলাও কোর্মা খায়, অতঃপর কনের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে চলে আসে। কনে আর ভাইয়ের ভাগ্যে জুটে না।
অবশেষে দীর্ঘ যুদ্ধের পর বড় ভাইয়ের বিয়ে হল বাড়ির কাছেই। মা একদিন সবার উপস্থিতিতে আমাকে ডেকে বললো, তোর বউ তুই নিজেই পছন্দ করে রাখবি।
মা তার সেই অমিয়বানীর কথা স্মরণ করে ভেতরে ভেতরে মনে হয় এখন বেশ আফসোস করতে লাগলো। আমার ছেলের বউ তো একটা পরী, চাঁদের টুকরা– এই টাইপের কথা পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনদের শুনিয়ে তৃপ্তি নেয়ার বঞ্চনা যেন তাকে প্রবলভাবে আহত করলো।
বাবা আমাকে সবসময় সমর্থন করেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না।
কাউকে হৃদয়ে স্থান দেয়া যায় সহজে কিন্তু সেই স্থানকে পোক্ত করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু অদ্রি খুব সহজেই সে কাজটা করেছে। আমাকে খুব সহজেই সে তার হৃদয়াসনে বসিয়েছে এবং সে আসন সুনিপুণভাবে সুদৃঢ়ও হয়েছে খুব সহজে। আমি জানি কেবল অদ্রি বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। তার ভেতর কোন ভণিতা নেই।
আমি একদিন তাকে বলি, অদ্রি তুমি এত সহজে আমাকে বিশ্বাস করলে কেনো বল তো? আমি তো ফ্রড হতে পারতাম?
অদ্রি হেসে বলে, আমার ভালোবাসার ক্ষমতা অসাধারণ। আমি জানতাম আমাকে তুমি কষ্ট দিতে পারবে না কখনো।
অদ্রির বিশ্বাস তার নামের মতোই অবিচল। আমি বললাম, সত্যি তোমাকে কষ্ট দিতে পারবো না কখনো।
সে ঠোঁটে রহস্যময় হাসি টেনে বলে, তাই বুঝি?
‘হ্যাঁ, কারণ তোমাকে কষ্ট দিলে সেই শেলটা তোমাকে যতটা বিদ্ধ করবে তার চেয়ে বেশি বিদ্ধ করবে আমাকেই। আমি কি জেনেশুনে নিজের কপালে কষ্ট টেনে আনবো।’
‘ইস! জাদুকর একটা।’
অদ্রি খুশি হলে এই বাক্যটা বলে। তার মুখ থেকে এই বাক্যটা শোনার জন্য আমি কেন জানি উদগ্রীব থাকি ভেতরে ভেতরে। এই বাক্যটা শুধুই বাক্য নয়।
আমার প্রেম বন্ধু সমাজে বেশ সমালোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো দ্রুতই। বন্ধুরা আমাকে প্রকাশ্যে খোঁচাও দিতে লাগলো- অলক, এই কালা মাইয়ার ভেতর তুই কি দেখলি? প্রেম করার কি আর কোন মাইয়া খুঁজে পাইলি না।
আমি বলি, দ্যাখ অদ্রি হল আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে। তোরা বুঝবি না।
বন্ধুরা যতই ক্ষ্যাপাক না কেন আমি জানি ভেতরে ভেতরে তারা আমাকে ঈর্ষা করে। অদ্রির প্রেমই আমাকে ঈর্ষনীয় করে তুলেছে। অদ্রি যে অতুলনীয়া।
মা আমকে নিবৃত্ত করার চেষ্টার কোন ঘাটতি রাখলো না। কয়েকটা মেয়ের ছবিও দেখালো। এদের মধ্যে একজনকে তার ভিষন পছন্দ।
‘অলক, এই মেয়েটা দ্যাখ কত সুন্দর। তোর খালু প্রস্তাব এনেছে।’
আমি নাক মুখ কুচকে বলি, ‘বিশ্রী।’
‘তুই ওই কালো মেয়েটাকেই বিয়ে করবি।’
‘কালো মানে অসুন্দর না মা। এই দেখো তার চোখ কত সুন্দর। হেমা মালিনীর চোখও এত সুন্দর নয়।’ আমি মাকে অদ্রির হলুদ শাড়ি পরা একটা ছবি দেখাই।
মা ছবি দেখে বলে, ‘যা কোথায় এত সুন্দর।’
সুন্দরকে এভাবে উপলব্ধি করা যায় না মা। মানুষের সৌন্দর্য থাকে বুকের ভেতর লুকানো। এই সৌন্দর্যের নাম হচ্ছে প্রেম। যার বুকে প্রেম যতো গভীর সে ততো বেশি সুন্দর। এই সুন্দর অবিনাশী। যাদের বুকের ভেতরটা সুন্দর তারাই এমন অবিনাশী সৌন্দর্যের অধিকারী হয়। অদ্রি হল এমন সুন্দর মা। চামড়ার সৌন্দর্য আমাদের কত দিন মুগ্ধ করবে মা যদি না তার ভেতর সুন্দর হয়। ওই চাকচিক্য একসময় অসহনীয় হয়ে উঠবে।
মা কোন কথা বললো না। আশ্বিন মাসের এক ফুরফুরে দিনে অদ্রির সাথে আমার বিয়ে হল।
তোমারেই করিয়াছি জীবনেরও ধ্রুবতারা– রবীন্দ্রনাথের এই গানটা আমার খুব প্রিয়। অদ্রি আমার জীবনে ধ্রুবতারা হয়ে এসেছে জন্যই মনে হয় গানটা আমার এত ভালো লাগে। অদ্রি শুধু আমার গানে মিশে থাকে না, তার প্রবল উপস্থিতি আমার প্রাণে বাজে সকল সময়, সকল কাজে। অদ্রি আমার ধ্রুব অনুভব, সে অনুভবের নাম মুগ্ধতা।
‘কিরে অলক কি করছিস?’
‘গান শুনছি মা?’
‘কার গান?
‘রবীন্দ্রনাথের! কিছু বলবে মা?’ আমি কান থেকে হেডফোন খুললাম।
‘তুই ঠিক অলক। আমিই ভুল ছিলাম। অদ্রির কোন তুলনা হয় না। ও অসম্ভব সুন্দর একটা মেয়ে।’
আমার ভেতর এক অসম্ভব ভালোলাগা কাজ করে। আমি আন্দোলিত হই। এই আন্দোলনকেই মনে হয় ভালোবাসা বলে।
আমি মাকে পরীক্ষা করার জন্য বলি, কিন্তু তোমার বউমা তো কালো মা।
মা আমার পীঠে চাপড় বসিয়ে বলে, ‘সাদা আর কালো সৌন্দর্য পরিমাপের মানদ- নয়। প্রত্যেকটা মেয়ের ভেতর এক অসীম সৌন্দর্য লুকানো থাকে। সেই সৌন্দর্যকে জয় করতে হয়। তুই সেটা পেরেছিস। অদ্রি অসীম সৌন্দর্যে তোর কাছে ধরা দিয়েছে। ওকে কখনো কষ্ট দিস না।’
আমি মাকে জড়িয়ে ধরি। এমন সময় অদ্রি এসে সামনে দাঁড়ায়। আমি তাকে আড়চোখে দেখি। তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানবী মনে হয়।