একাত্তরের মার্চ–প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মাস

-এবাদত আলী
১৯৭১ সালের মার্চ মাস গোটা বাঙালি জাতির জন্য ছিলো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মাস। এই মাসের প্রথম দিন থেকেই ছিলো জোর প্রতিবাদের ভাষা। তৎকালিন পুর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ছিলো প্রতিবাদ মুখর। ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা সেই উত্তাল মাচের্র গোড়া থেকেই বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সমগ্র পুর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। সমগ্র পুর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন অচল হয়ে পড়ে। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পুর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠনের অধিকার অর্জন করে কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার পুর্ব-পাকিস্তানিদের হাতে ক্ষমতা দিতে কোনমতেই রাজি ছিলনা। যদিও ৩ মার্চ তারিখে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ নির্ধারিত হয় , কিন্তু ভেতরে ভেতরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং সামরিক বাহিনীর অফিসারেদের নিয়ে ষড়যন্ত্রের নীল নকসা বুনতে শুরু করেন।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ কোন কারণ ছাড়াই ৩ তারিখের নির্ধারিত অধিবেশন বাতিল করা হয়। এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ পুর্ব-পাকিস্তানের মানুষের ধৈর্যের সিমা ছাড়িয়ে যায়। সারা দেশে বিক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরিতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা দেশে ৫ দিনের হরতাল এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।তাঁর আহবানে সারা পুর্ব-পাকিস্তান কার্যত অচল হয়ে পড়ে। সামরিক সরকার কারফিউ জারি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায় কিন্ত এতে আন্দোলন প্রশমিত হয়না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ নেতাদের কথায় প্রশাসন পরিচালিত হতে থাকে। সারা দেশের ছাত্র-জনতার কন্ঠে তখন একই ধ্বনি আকাশে বাতাসে প্রকম্পিত হতে থাকে ‘ বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। বাঁশের লাঠি তৈরি করো পুর্ব বাংলা স্বাধীন করো। পিন্ডি না ঢাকা- ঢাকা ঢাকা। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা। জয় বাংলা, জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। জয় বঙ্গবন্ধু। ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন অবস্থায় পাকিস্তানি শাসকবৃন্দ কঠোর হতে কঠোরতর পদক্ষেপ গ্রহন করতে থাকে। বিভিন্ন অজুহাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা এদেশের সাধারণ মানুষকে নির্বচারে গুলি করে হত্যা করতে থাকে।
এদিকে ছাত্র-জনতা ও সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারিগণ পুর্ব-পাকিস্তানের সমস্ত প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অচল করে তোলে। ২ মার্চ ‘ ৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা প্রদর্শিত হয়। ডাকসুর ভিপি আ.স.ম. আব্দুর রব পতাকা উত্তোলন করেন।
৩ মার্চ ‘ ৭১ এ রমনা রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে) স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক উপাধিতে ভুষিত করা হয় এবং‘ স্বাধীনতার ইশতেহার’ পাঠ করা হয়। এই ইশতেহারে ‘ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
৪ মার্চ এদিন বাংলার মুক্তি পাগল মানুষ বিক্ষুব্ধ শোভাযাত্রা, গায়েবানা জানাজা, সভা ও স্বাধীনতার শপথ নেয়ার মধ্য দিয়ে পার করে। দিনটি ছিলো বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের লাগাতর হরতালের চতুর্থ দিন। স্বাধিকার আন্দোলন জোরদার করার লক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আহবানে ভোর ৬ টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত ঢাকাসহ গোটা প্রদেশে হরতাল পালিত হয়। গোটা দেশ চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। চারদিকে শুধু একই শ্লোগান মুজিব তুমি এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সাথে, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা। এই হরতালে পুর্ব-পাকিস্তানের বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা সম্পুর্ণভাবে অচল হয়ে পড়ে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের পুর্ণাঙ্গ রূপরেখা ও ইশতেহার ঘোষণার পর সমগ্র দেশ একটি বারুদের গোলকে পরিণত হয়। আন্দোলন সংগ্রামের এ অবস্তায় এসে সর্বত্র চলতে থাকে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি। শহরে, গ্রামে-গঞ্জে, হাটে মাঠে ঘাটে সব জায়গায়ই উজ্জীবিত মানুষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বতস্ফুর্ত জীবন-মরণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদিন পশ্চিমা সামরিক বাহিনী ঢাকায় অকার্যকর কারফিউ তুলে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু খুলনা ও রংপুরে কারফিউ বলবৎ রাখে। ঢাকা বিমান বন্দরে সাধারণ মানুষের সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। তবু বসে থাকেনা বিক্ষুব্ধ বাঙালি। দিনভর রাস্তায় রাস্তায় চলে ব্যারিকেডের কাজ। সকল সরকারি বেসরকারি অফিস আদালত সবই বন্ধ থাকে। সেই সাথে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্বশাষিত সংস্থা, বিমান, রেল, স্টিমার, লঞ্চ, বাস, ট্যাক্সি, ব্যাংক-বীমা, ইনসুরেন্সসহ সকল প্রতিষ্ঠান। ৩ ও ৪ মার্চে সেনাবাহিনীর গুলিতে চট্রগ্রামে ১শ২০জন নীরিহ মানুষ শহীদ হন। দুদিনে মোট আহতের সংখ্যা ৩শ৩৫জন। খুলনায় ২ মার্চ থেকে হরতাল চলছিলো। এসময় শহীদ হন ৬ জন। আহত হন বেশ কয়েকজন। বিক্ষুব্ধ জনতা পাকিস্তানি সৈন্যদের গাড়ি বহর প্রতিরোধের জন্য পথে পথে গাছের গুড়ি ও বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহন উল্টো করে রেখে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে।
এদিন হাজার হাজার জনতা পরবর্তী নির্দেশ শোনার জন্য বিকাল থেকেই ধানমন্ডির ৩২নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনের সানে জড়ো হতে থাকে। নিরস্ত্র নীরিহ সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে বয্গবন্ধু এই দিনে পাকিস্তান সরকারের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আর যদি এক ফোটা রক্ত ঝরে যদি আবারো গুলি চালানো হয় তবে তার সকল দায় দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে। বাংলার মানুষকে হত্যা করে স্বাধিকার আন্দোলন ঠেকিয়ে রাখা যাবেনা। এদিন টঙ্গির শিল্প এলাকায় আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী গুলি চালালে ঘটনাস্থলেই ৪ শ্রমিক শিহীদ হন এবং ১৪/১৫জন আহত হন। সমগ্র টঙ্গিতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। দেশের বরেণ্য লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি ও বুদ্ধিজীবীরাও বিবৃতি দিয়ে নীরিহ বাঙালি ওপর পাকিস্তান বাহিনীর গুলির তিব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষিত কর্মসুচির প্রতি একাত্বতা প্রকাশ করেন। এদিন ৪ মার্চ মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, দুভিক্ষ ও অভাবের কবলে পড়ে পুব-বাংলার মানুষের পেটে আজ ভাত নেই। এ অবস্থার মধ্য থেকেও তারা বাংলার স্বাধীনতা ও সার্বভৈৗমত্বের ন্যায্য দাবি নিয়ে যে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তাতে বাধা দেয়া হলে দেশে আগুন জ্বলবে। কেই চুপ করে বসে থাকবেনা।
এরকম উত্তাল পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাস ভবনে আওয়ামী লীগের এক মুলতবি সভায় ভবিষ্যৎ কর্মসুচি ব্যাখ্যা করে সংগ্রামের নতুন দিকনির্দেশনায় বলেন, আজ আওয়ামী লীগ নয় গোটা বাঙালি জাতিই অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখিন। আমাদের সামনে আজ দুটো পথ খোলা আছে। এককটি সর্বাত্বক ত্যাগ স্বীকারের জন্য নিজেদের মনোবল অটুট রেখে অবিচলভাবে পুর্ণ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়া অথবা ভুট্টো ইয়াহিয়ার কথামত সব কিছু মেনে নেওয়া। নিজের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, আপনারা জানেন আমি সারা জীবন ক্ষমতার মসনদের আশা তুচ্ছ জ্ঞান করে দেশ ও জাতির কাছে আমার জীবন মর্গেজ রেখেছি। বাংলার মানুষ গুলি খেয়ে বন্দুকের নলের কাছে বুক পেতে দিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে আমাকে মুক্ত করে এনেছে। আমার ৬ দফা কমসুচির প্রতি ম্যান্ডেট দিয়েছে। এখন শহীদের পবিত্র আত্মত্যাগের প্রতি অশ্রদ্ধা জানিয়ে পাকিস্তানের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে অবমাননাকর শর্তে কি করে ক্ষমতায় যাই। এ দিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের নামকরণ করেন ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’। পাকিস্তান টেলিভিশনের নাম পাল্টে ‘ঢাকা টেলিভিশন’ নাম দিয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতে থাকে। কার্যত সারা বাংলা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে। (চলবে) (লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!