এডওয়ার্ড কলেজ অধ্যক্ষ’র টাকা আত্মসাত : কথকথা
কৃষ্ণ ভৌমিক:
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ আমার আবেগ, উচ্ছৃাস আর প্রাণের তীর্থভুমি। এখনও ক্যাম্পাসের গাছপালা, ধুলিকণার সাথে আত্মিক বন্ধন অনুভব করি। জ্যোৎস্নায় মহুয়াতলায় মাতালকরা গন্ধের পরশ আজ ও অনুভবে সারা দেয়।এইচএসসি থেকে ব্যবস্থাপনা অনার্স পযন্ত সেশনজটে অনেক বছর ক্যাম্পাসে বসবাস।মনের গভীরে লুকায়িত ভালোবাসার সে সব অনুরণন এখন দু:খ জাগানিয়া স্মৃতি।
তাই প্রাণের আকুতিভরা কলেজটির অধ্যক্ষর বিরুদ্ধে যখন টাকা আত্মসাতের মামলার খবর পেলাম তখন মনের মধ্যে উত্তপ্ত এক ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেলো। তখন শুধু লজ্জিতই হলাম না দ্রোহের আগুনে মনটা জ্বলে উঠলো। ভুয়া ভাউচার,জালিয়াতি ও প্রতারণামুলক অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে কলেজ অধ্যক্ষ ড. হুমায়ুন কবির মজুমদারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।দুদক পাবনার উপ সহকারি পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান ৭ জুন সোমবার মামলাটি করেছেন।
দুদক সুত্রে জানলাম অধ্যক্ষ ড. হুমায়ুন কবির মজুমদার ভুয়া বিল ভাউচার ও জালিয়াতির মাধ্যমে ছাত্র সংসদ, উন্নয়ন তহবিল,ভর্তি কার্যক্রম,ফরম ফিলাপ বাবদ ৫৬ লাখ ৮ হাজার ৯৮৬টাকা অগ্রণী ব্যাংক কলেজ শাখা থেকে তুলে আত্মসাত করেন।
কলেজ ছাত্র সংসদ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলেও অধ্যক্ষ ৫ ছাত্রলীগ নেতা ও কর্মচারীর নামে ভুয়া বিল ভাউচার দেখিয়ে ১৫টি চেকে ৫ লাখ ২২ হাজার,উন্নয়ন তহবিলের কোটেশন ছাড়াই ভুয়া বিল ভাউচার করে ৩৮টি চেকে ১৯ লাখ ৯৯ হাজার ২শ৩৮ টাকা,বিবিধ তহবিলের ৩৭ টি চেকে ১৩ লাখ ৪হাজার ৪২ টাকা,উন্নয়ণ তহবিলের বেসরকারি আয় থেকে ২৮টি চেকে ১৮ লাখ ৩ হাজার ৭০৬ টাকা আত্মসাত করেছেন ।
দুদক আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপপরিচালকমোজাম্মেল হক আরও জানান অধ্যক্ষের ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতির আরও বিভিন্ন বিষয় তদন্ত চলছে।মামলার প্রয়োজনে যে কোন সময় তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে।
সাংঘাতিক পীড়াদায়ক এ খবরটি পড়ে মনের মধ্যে প্রচন্ড ধাক্কা অনুভব করলাম।নিজের মনেই প্রশ্ন করলাম চোর কে? অধ্যক্ষ? তাও সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের ? অধ্যক্ষের নীতি নৈতিকতা বলে কি কিছু নেই ? মুল্যবোধ ও শুণ্য ? বিবেক ও রুদ্ধ? অধ্যক্ষ স্ত্রী সন্তানদের কি জবাব দিবেন? অধ্যক্ষের সন্তানের পরিচয় কি হবে? চোরের সন্তান? সমাজে তারা মুখ দেখাবে কেমন করে? অধ্যক্ষের মনস্তাত্বিকতায় যদি চুরি বাসা বাঁধে তাহলে প্রশাসনের সৃষ্টিশীলতা কি আশা করা যায়? কি শিখবে ছাত্ররা? এরকম অসংখ্য প্রশ্ন মনের মধ্যে ভীড় করছে।
যদিও অধ্যক্ষের কাছে এ প্রশ্নের কোনটিরই উত্তর নেই। কারণ অত্যন্ত পরিস্কার।তাঁর মনে আর আত্মসমালোচনার কোন সুযোগ নেই।অধ্যক্ষের বিবেকটা যে ঘুমন্ত।লোভ লালসা তাঁর বিবেকের ঘরে তালা লাগিয়েছে। তাই এখন তাঁকে চুরি ঢাকতে কত ফন্দি ফিকিরের আশ্রয় নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে এটাই সত্যি।আর এ ফন্দিফিকিরের সবই যে মিথ্যার বেসাতি সেটাও বলার অপেক্ষা রাখে না।
আর আপনি হয়তো আমলা,রাজনীতিবিদ,ব্যবসায়িসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার দুর্নীতিবাজদের অনিয়ম অর্থ লুটপাটের সাথে নিজেকে মিলিয়ে সান্ত্বনা খুঁজবেন এটাই স্বাভাবিক। একজন অপরাধীর এভাবে সান্ত্বনা খোঁজার মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যা কি সেটা আমার চেয়ে অপরাধ বিজ্ঞানিরাই ভালো বলতে পারবেন।তবে আমার কাছে সেই প্রবাদই যথার্থ মনে হচ্ছে- চোরে চোরে মাসতুত ভাই।
তবে হ্যাঁ অন্য পেশার চুরি,টাউটগিরি,প্রতারণার সাথে সরকারি এডওয়াড
কলেজের অধ্যক্ষ’র সামিল হওয়া এটা কিছুতেই কাম্য নয়। বেসরকারি কলেজের অধক্ষে’র কথা না হয় বাদই দিলাম।বেসরবারি কলেজের অধিকাংশই রাজনৈতিক পেশিশক্তি, টাকা,ক্ষমতার বলয়ে অযোগ্য, অসৎ,ব্যক্তিত্বহীন, চামচারা না হয় এ পদে বসে এমনটি করলে মানায়। কারণ তাদের কলঙ্কিত ইতিহাসেই জন্ম। কিন্তু আপনাদের কি এসব মানায়?
একটু ভাবুন তো আপনি যত টাকা বেতন পান তা কি ভালোভাবে সংসার চলার নয়। অবশ্যই চলে।তবে আমার কাছে মনে হয় পারিবারিক শিক্ষাহীনতা মানুষের মধ্যে মুল্যবোধহীনতা সৃষ্টিতে বড় ভুমিকা রাখে। হয়তো তার মধ্যে এ শিক্ষার ঘাটতি রয়েছে। তার অর্থই হচ্ছে ভোগবাদিতাতা, উচ্চাকাঙ্খাকেই আপনাকে এ অর্থ আত্মসাতে উৎসায়িত করেছে বলে মনে হয়েছে।
কিন্তুআপনি কি জানেন আপনার কাছে জাতীর প্রত্যাশা কতটুকু? আমি মনে করি এডওয়ার্ড কলেজের মতো সরকারি কলেজের অধ্যক্ষকে অবশ্যই নীতি নৈতিকতায়,মানবিক চেতনাসমৃদ্ধ একজন আদর্শবান শিক্ষক হতে হবে।যে শিক্ষকের ব্যক্তিত্বের কাছে অধিনস্ত শিক্ষক,কর্মচারি,ছাত্র, সুধিমহল শ্রদ্ধা ভক্তিতে মাথা নত করবে। ব্যক্তিত্বে তিনি হবেন সমাজের কাছে অনুসরণীয় ।আর তিনি যদি নীতি নৈতিকতাহীন, অর্থলোলুপ হন তাহলে তিনি ঘৃণার পাত্র।যেমনটি এখন আপনার বেলায় প্রযোজ্য।
আমি পর্যবেক্ষণে বলছি সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের মতো কলেজে প্রতিবছর উন্নয়ন খাতসহ ভিন্ন ভিন্নখাতে বেসরকারি আয়ের যে টাকা জমা হয় তার পরিমাণ কিন্তু ৫-১০ লাখ না। কোন অধ্যক্ষ সৎ হলে এ টাকা দিয়ে বছরে পরিবহণ পুলে কমপক্ষে ৪টি করে নুতন বাস যোগ করা যায় বলে মনে হয়। কিন্তু সেদিকে কি নজর দেয়া হয়েছে? শুধুই নিজের পকেট ভারীর চিন্তায় ছো ছো করা।
লিখতে বসে মনে হচ্ছে আমাদের শিক্ষিত লোকদের উচ্চাভিলাস, অসততা, নষ্টামি, ভন্ডামি, অর্থলোলুপতা, দালালি এমন পর্যায়ে পৌছিয়েছে যে ভাবতেই গা ঘিন ঘিন করে।একবার আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখুন তো? আপনার মধ্যে কি আদর্শ বলে কি কিছু আছে? একজন অধ্যক্ষের পদের আড়ালে একজন চোরের বসতি ভাবতেও ঘৃণাবোধ করছি।
ছি ছি। ধিক্কার জানাই বিবেকহীণতাকে।আপনি ও কি বলবেন শয়তান আমার উপর ভর করেছিল তাই সে করেছে।আমার কোন দোষ নেই।হায়রে হায় আমরা দিন দিন কি নিকষ অন্ধকারের গহ্বরে নিমজ্জিত হচ্ছি।
অধ্যক্ষ’র অপসারণ দাবিতে মামলার পরদিন দুপুরে তার কার্যালয়ের সামনে ছাত্রদের মানববন্ধন ও সমাবেশ দেখলাম। মাস দুই আগে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কলেজের ক্যালেন্ডার ও ডায়েরীতে কুখ্যাত খুনি মুশতাকের ছবি ব্যবহারের প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখলাম।
সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম ও মুক্তিযুদ্ধ’৭১ ও একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পাবনা জেলা শাখার ব্যানারে এ প্রতিবাদ হয়। সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ’৭১ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ও জেলা শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. স. ম. আব্দুর রহিম পাকনের নেতৃত্বে প্রতিবাদ সভায় বক্তা ছিলেন জেলা আওয়ামীলীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পদাক বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হক টিংকু, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পাবনা সদর উপজেল শাখার আহবায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী জববার, বাংলাদেশ আওয়ামী সাংস্কৃতিক ফেরামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সম্পাদক মো. আবুল কাশেম, সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ’৭১ জেলা শাখা’র নির্বাহী সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম রফিক প্রমুখ।
কি অধপতন দেখতে হচ্ছে আমাদের।একের পর এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভিসির কি কদর্য চেহারা উঠে আসছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ২য় শ্রেণি ১ বিষয়ে ফেল তাকে ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়াসহ ভিসির দুর্নীতি অনিয়ম দেখে হতবাক।
একজন ভিসি ছেলে,ছেলের বউ,মেয়ে,জামাই, ভাই.ভাতিজীসহ পরিবার পরিজনকে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দিতে পারেন কি? এদের কি হায়া বলে কিছু নেই? যখন একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পরিবার পরিজনের ব্যাংক হিসাব জব্দসহ কাঠগড়ায় দাড়ানোর খবর শুনি তখন কি মনে হয়?
ধিক্কার জানানোর ভাষাও হারিয়ে যায়।দেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কান্ডজ্ঞাণহীণ অর্থলোলুপতা,নিলজ্জতা.দুর্নীতি, অনিয়ম দেখে ভিসির এ পদেটিই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
এদের ভোগবাদিতা, নিলজ্জতা, বেহায়াপনা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের শ্রদ্ধা করার মতো আর কিছুই থাকলো না।আর আপনাদেরই যেখানে নৈতিকতার ভান্ডার শুন্য সেখানে আপনাদের থেকে কি শিখবে আমাদের সন্তানরা ? এ প্রশ্নও আজ ভাবিয়ে তুলেছে।চারিদিকে শুধুই অন্ধকারের প্রতিধ্বনি দেখছি।
প্রাণপ্রিয় কলেজে মোসলেম উদ্দিন, আব্দুর জব্বারসহ অন্তত ৭ -৮ জন অধ্যক্ষের সাহচর্যলাভ করেছি। কিন্তু তাদের টাকা চুরির কোন নজির বা অভিযোগ উঠেনি। আমার মনে আছে একবার ডিগ্রি কলেজ রোডের ঝড়ে ভাঙ্গা লিচু গাছ কেটে অধ্যক্ষ’র বাড়িতে ব্যবহার করা নিয়ে তুমুল ছাত্র আন্দোলন দানা বাধে।
বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা অধ্যক্ষর কার্যালয় ঘেরাওয়ের সময় এক ছেলে অধ্যক্ষ কার্যালয়ের সামনের টেলিফোনের খাম্বায় উঠে তার কাটতে নেয়।এ সময় দলিল উদ্দিন মন্ডল স্যার গিয়ে ধমকিয়ে ছাত্রটিকে নামিয়ে এক থাপ্পর মারেন।শুধুমাত্র ভাঙ্গা লিচু গাছের জন্য অধ্যক্ষ স্যারকে ছুটির মধ্যে বদলি নিয়ে চলে যেতে হয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল এ ঘটনায় তিনি এতই লজ্জা পেয়েছিলেন যে ছাত্রদের কাছে মুখ দেখাতে ও তিনি পারছিলেন না। কিন্তু তাদের একজনের বিরুদ্ধে ও টাকা চুরির কোন অভিযোগ উঠেনি।
একটি কথা আমার মনে বার বার বাজে তা হলো- শিক্ষিতরাই দেশের সবচে’য়ে বেশি ক্ষতি করেছে বা করছে।একজন অশিক্ষিত কৃষক শ্রমিক তাদের পেটের তাগিদে কাজ করছে বলেই দেশের জিডিপিতে তা অবদান রাখছে।
আর কথিত এ শিক্ষিতরা? দেশ তাদের অনেক কিছু দিয়েছে কিন্তু ওরা দেশকে কি দিচ্ছে? বরং অধিকাংশই প্রতিনিয়ত দেশকে কর্ষণ করে দেশ বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। কিন্তু এভাবে আর কতকাল? আমাদের এ শিক্ষিত সমাজের বিবেক কবে জাগ্রত হবে সে দিনটির অপেক্ষায় রইলাম।
কৃষ্ণ ভৌমিক
সংবাদকর্মী,দৈনিক জনকণ্ঠ
পাবনা,বাংলাদেশ