কথা নিয়ে কিছু কথা–এবাদত আলী
এ জীবনে কেউ কথা দিয়ে কথা রাখেনি বলে বিরহ ব্যাথার উপশম ঘটানোর জন্য যে লিখছি সে কথা যেমন জোর দিয়ে বলা যায়না, তেমনি কথার ফুলঝুরি দিয়ে কাউকে উপহাস বা কারোর প্রতি কটাক্ষ হেনেও নিশ্চই কোন কথা লেখা হচ্ছেনা। তবে কেউ যদি কথা দিয়ে কথা না রাখে তবে সে কথা যত সংগোপনেই বলা হোক না কেন তা কথায় কথায় যে রাষ্ট্র হয়ে যায় সে কথা অনস্বীকার্য।
কথা বা কথোপকথন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সেই যে শিশুকালের আধো ফোটা তোতলানো কথার মধ্য দিয়ে যে কথার সুচনা তা কৈশোর, যৌবন এবং বৃদ্ধকাল, এক কথায় আমৃত্যু পর্যন্ত তা লাগামহীন ভাবে চলতে থাকে। তবে বাকপ্রতিবন্ধী বা বোবাদের বেলায় কিংবা বয়োবৃদ্ধের মধ্যে যাদের জবান ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে তাদের বেলায় একথা প্রযোজ্য নয়।
কথা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো উক্তি, বচন, বিবৃতি, গল্প, আখ্যান, আলাপ বা শলা পরামর্শ করা। তবে কথার আদি বৃত্তান্ত সর্ম্পকে অনুসন্ধান করে যতদুর জানা যায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যখন আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আ.) কে মাটি দ্বারা তৈরি করে তার কলবের মধ্যে রূহ প্রবেশ করাতে গেলেন তখন হযরত আদম (আ.) সহ সকল আত্মাকে জিজ্ঞাসা করা হলো “আল আসতুবি রাব্বিকুম” অর্থাৎ আমি কি তোমাদের রব বা প্রভু নই?
তখন আত্মাগণ বলেছিল (কালু) বালা, অর্থাৎ হাঁ (হে প্রভু আপনিই আমাদের প্রতিপালক)। আর এই অঙ্গিকারের কথা দিয়েই যে মানব সমাজের কথার সুচনা তা বোধ করি বলার অপেক্ষা রাখেনা।
আবার আদি পিতা হযরত আদম (আ.) ও মাতা হাওয়া (আ.) কে বেহেস্তে বসবাসের অনুমতি দিয়ে মহান আল্লাহতায়ালা তাদেরকে একটি গাছের নিকট যাবার কথা নিষেধ করেছিলেন এবং বলেছিলেন, তোমরা যদি এই গাছের কাছে যাও তাহলে তোমরা জালেমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু মানুষের চরম ও পরম শত্রু ইবলিশ শয়তানের মিষ্টি কথায় বিভ্রান্ত হয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার কথা ভুলে গিয়ে সেই গাছের ফল খেয়ে হযরত আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.) বেহেস্ত থেকে বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীর মাটিতে নীত হয়েছিলেন। প্রায় ৩শ ৭৫ বছর কাল তারা নিজেদের কৃত কর্মের কথা স্মরণ করে মহান আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। অবশেষে আল্লাহর হাবিব হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর উছিলার কথা বলে আল্লাহ তায়ালার নিকট হতে পাপ মুক্তি ঘোষণার কথা শ্রবন করেছিলেন এবং সকল পাপের ক্ষমা হয়েছিলো। হযরত মোহাম্মদ (সা.) পবিত্র মেরাজে গিয়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। যীশুখ্রিষ্ট তার অনুসারিদের উদ্দেশ্যে শিশুকালে দোলনায় শুয়েই কথা বলেছিলেন। হিন্দু পৌরানিক কাহিনীতে মুনি-ঋষিগণ কথার মাধ্যমেই “তথাস্তু” বলে বর দিতেন।
আমাদের সমাজ জীবনে পরস্পরের মধ্যে কথোপকথন বা আলাপ আলোচনাকে বলা হয় কথাবার্তা। কোন প্রস্তাব উত্থাপন করাকে বলা হয় কথা পাড়া। কথা এড়ানো বা প্রতিবাদ করা কেবলা হয় কথা কাটা। প্রতিশ্রতি ভঙ্গকে কথার নড়চড়, বাক্যের তীক্ষèতাকে কথার ধার, অনেক কথার মাঝে একটি মাত্র কথাকে বলা হয় লাখ কথার এক কথা। বিভিন্ন কায়দা-কৌশলে কথা বলা কে বলা হয় কথার মারপ্যাঁচ। কারো সঙ্গে অঙ্গিকার করা বা ওয়াদাবদ্ধ হওয়াকে বলে কথা দেওয়া। কারো সঙ্গে ঘনিষ্ট ভাবে মিশে তার নিকট থেকে আসল কথা বের করাকে বলা হয় কথা দিয়ে কথা নেওয়া। কোন কথার অবতারনা করাকে বলে কথা পাড়া। আরবীতে একটি কথা আছে আলহাক্কু মুররুণ অর্থাৎ হক কথা তিক্ত। গুরুজনেরা বলেন সদা সত্য কথা বলিবে।
কথার যে এত মাহাত্ব তা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে স্পষ্টভাবে বুঝা গিয়েছিলো। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদিন রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) দিশেহারা বাঙালির মুক্তির জন্য যে ঐতিহাসিক কথা উপস্থাপন করেছিলেন তাতে গোটা জাতি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলো। সেই বজ্রকন্ঠের কথার সুত্র ধরেই দেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও এদেশের দালাল , রাজাকারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলো। ছাত্র-যুবক সহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষহাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো। দীর্ঘ ৯ মাস মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদেরকে পরাজিত করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কোন কথা নেই। হয়তোবা সে কারণেই রাজনীতিবিদদের মধ্যে কেউ কেউ কথা বলতে গিয়ে মুখে ফেনা তোলেন। কারও কারও আবার কন্ঠনালীর রগ টানটান হয়ে যায়। আমাদের দেশে কোন কোন সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে কথা চালাচালি হয় যাকে বলা হয় ‘সংলাপ।’ বিভিন্ন সময়ে দেশের মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীদের মুখ ফসকে এমন সব বেলেহেজ কথা বার্তা বেরিয়ে পড়ে যা শুনে দেশের সচেতন নাগরিকগণ হেঁসে লুটো পুটিখায় এবং এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়। শুধু তাই নয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল গুলোতে এসব কথা নিয়ে ‘টক শো’হয়ে থাকে। আবার টক শোতে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের কান্ড জ্ঞানহীন কথাবার্তা বলার অপরাধে বাদ প্রতিবাদ হয় এমন কি মানহানীর মামলা পর্যন্ত ও গড়ায়।
উপন্যাস, গল্প ও গদ্যে লিখিত অন্যান্য রস সাহিত্য প্রণেতাকে বলা হয় কথা শিল্পী। যাদের গলা দিয়ে গানের কথা বা কলিসুরের সাথে বেরিয়ে আসে তাদেরকে বলা হয় কন্ঠশল্পী। তিরস্কার সহ্য করা, কথায় সায় দেওয়া এবং কথা মান্য করা কেবলা হয় কথা শোনা। শিশু, ময়না ও তোতাপাখি, হতবাক ব্যক্তি প্রভৃতির মুখে অর্থযুক্ত শব্দ উচ্চারিত হওয়াকে বলে কথা ফোটা। কথা বেশি বেশি বললে লোকে বলে কথার খই ফুটেছে। তবে অত্যাধিক কথা কিংবা অসংলগ্ন কথা বলাকে লোকে বলে বাচাল বা পাগল। কথার চুলচেরা বিচার করলেই মানুষের দোষ গুনের কথা জানা যায়। চোখ ইশারায় কাছে টানলে ও প্রেমের অভিব্যক্তি প্রকাশে কথার আধিক্যই অত্যাধিক। অভিমানির মান ভাঙ্গাতে কথার জুড়ি মেলা ভার।
বিয়ে সাদির কথা দেওয়ার পুর্বে কথা পাকা-পাকি করতে হয়। কথার মাধ্যমেই বর-কনের বিয়ে পড়ানো হয়। বাসর ঘরে বর কনেরা নানা রকম রোমাঞ্চকর কথার মধ্য দিয়েই তাদের দাম্পত্য জীবনের সুচনা করে থাকে।
কথায় বলে শুধু কথায় চিড়া ভেজেনা। মুরুব্বিরা বলেন কান কথা শুনোনা বা যে কোন কথা কানে তুলে কান ভারি কোরনা। মধুরমত মিষ্টি কথা শুনলে হৃদয় জুড়ায়। এমন অনেক ব্যক্তি আছে যার কথা শুনলে গাজ্বালা করে। কথায় নাকি গায়ে ফোস্কা পড়ে। কথায় কথায় ঝগড়াঝাটি শুরু হলে তাকে বাক-যুদ্ধও বলা হয়।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত বাউল সাধক ফকির লালন শাহ তার বিখ্যাত গানে বলেছেন-
“হাতের কাছে নড়েচড়ে/ খুঁজলে জনমভর মেলেনা-/ কে কথা কয়রে দেখা দেয় না ॥” বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- “আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল / শুধালোনা কেহ।”আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন- “বউ কথা কও !বউ কথা কও / কও কথা অভিমানিনী।”আমাদের দেশের লোক কথায় আছে- ‘কথার নেই মাথা/ ব্যাঙে চিরে খায়- ম’ার বিয়ে না হতেই- ঝিনায় ওরে যায়।’কথায় কথা বাড়ে মন্থনে ওঠে ঘি। কু-কথা বাতাসের আগে ধায়।
আমাদের সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি আছে- যারা বেশি কথা বলে। অনেকেই যে তুলনায় কথা বলে- সে তুলনায় কাজ করেনা। তাই কবি বলেছেন-“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে। আরো প্রচলিত আছে “দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথা, ঘনিয়ে বসে কাছে, কথা দিয়ে কথা নিয়ে, প্রাণে বধে শেষে।”
অনেকে আবার মৃত্যুর আগে শেষ কথা বলে যান। মৃত্যুর পরে অনেককে নিয়ে অনেক কথা হয়। কথা দু’রকমের। মুখের কথা এবং মনের (অন্তরের) কথা। তবে মুখের কথা বুঝা গেলেও মনের কথা বুঝা যায়না। (লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট