গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও থেমে নেই ঈদযাত্রা

ডেস্ক : বৈশ্বিক মহামারি করোনার সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সোমবারও সর্বোচ্চ মৃত্যু ও সর্বোচ্চ আক্রান্তের তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। দেশব্যাপী সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় রাজধানীতে প্রবেশ বা বের হওয়ায় কড়াকড়ি আরোপ করার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। কিন্তু সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নে নিয়োজিত পুলিশ কড়াকড়ির কথা বললেও চিত্র একেবারেই ভিন্ন। রাজধানী থেকে বের হওয়ার সবগুলো পথের মুখেই ঢল নেমেছে ঘরমুখো মানুষের।

সরকারের দেয়া ১৪ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নে রাজধানীর সবগুলো বের হওয়ার পয়েন্টে পুলিশকে সক্রিয় দেখা গেলেও মানুষের নানান যৌক্তিক-অযৌক্তিক কারণে অনেকটা অসহায় অবস্থায় পুলিশ সদস্যরা। গাড়ি চলাচল বন্ধে কঠোর পুলিশের চেকপোস্টগুলো। তারপরও ঘরে ফিরতে ব্যাকুল মানুষ হেঁটে পেরিয়ে যাচ্ছেন এসব চেকপোস্ট। চেকপোস্ট পেরিয়ে সামনে গিয়ে পিকআপ ভ্যান, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহনে চেপে মানুষের ঢাকা ত্যাগ করার চিত্র চোখে পড়ার মতো। ঢাকার কল্যাণপুর, গাবতলী, আমিনবাজার, উত্তরা হাউস বিল্ডিং, টঙ্গী, আশুলিয়া এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর সাইনবোর্ড, বাবুবাজার ব্রিজ এলাকায় দেখা গেছে একই চিত্র। এই অবস্থায় অনেকটা অসহায়ই দেখা গেছে পুলিশকে। লাখো মানুষের ঢলে চেকপোস্টগুলো অচল হওয়ার দশা। গত ১৪ মে মন্ত্রিপরিষদ থেকে ১৫ দফা নির্দেশনা জারি করে সাধারণ ছুটি বর্ধিত করা হয়। নির্দেশনায় বলা হয়, সাধারণ ছুটি ও চলাচলে নিষেধাজ্ঞায় কেউই কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারবেন না। এই সময়ে সড়কপথে গণপরিবহন, যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল এবং অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল বন্ধ থাকবে এবং মহাসড়কে মালবাহী/জরুরি সেবায় নিয়োজিত যানবাহন ছাড়া অন্যান্য যানবাহন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

নিষেধাজ্ঞাকালে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় এবং এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় জনসাধারণের চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকবে। জেলা প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই নিয়ন্ত্রণ সতর্কভাবে বাস্তবায়ন করবে। এরই ধারাবাহিকতায় গত রোববার আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ মাঠ পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেন, ঈদ উপলক্ষে ও সরকার ঘোষিত বর্ধিত ছুটি উদযাপনের জন্য অনেকেই গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন। এটি কোনোভাবেই হতে দেয়া যাবে না। প্রধানমন্ত্রী যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন, তা সবাইকে যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। সাধারণ মানুষকে সরকারি নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

ঢাকা শহরে প্রবেশ ও বের হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ওইদিন থেকেই নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে সক্রিয় হয় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা চলাকালে গত রোববার থেকেই ঢাকা থেকে ঘরে ফিরতে উদগ্রীব মানুষ, যা সোমবার থেকে আরও বেড়ে যায়। গণপরিবহন চলাচল বন্ধ থাকায় রাজধানী থেকে বের হওয়া পণ্যবাহী ফিরতি ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, প্রাইভেটকার, এমনকি মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিতে দেখা যায় মানুষকে।

সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে বের হওয়ার সবগুলো পয়েন্টেই লাখো মানুষের ঢল নামে। সাহরির পর থেকে যেন পুলিশি কোনো বাধায় আটকানো যাচ্ছে না মানুষকে। রাজধানীর গাবতলী, আমিনবাজার ব্রিজে চেকপোস্ট বসিয়েছে পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে চেকপোস্টে গিয়ে দেখা গেছে, গাবতলী বাস টার্মিনালের কাছে আমিনবাজার ব্রিজে পুলিশ ঢাকা থেকে বের হওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে ঢাকা থেকে সাভারে যারা অফিস করার উদ্দেশে বেরিয়েছেন তারা আটকা পড়েছেন। আমিনবাজার ব্রিজ থেকে টেকনিক্যাল মোড় পর্যন্ত যানজট। এর মধ্যেও ঘরমুখী মানুষ দলে দলে পায়ে হেঁটে ঢাকা ছাড়ছেন। অনেকে গাড়ি থেকে নেমে চেকপোস্ট পেরিয়ে অন্যান্য যানবাহনে ঢাকা ছাড়ছেন। ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগের সহকারী কমিশনার কে এম শহীদুল ইসলাম সোহাগ বলেন, জরুরি সেবায় নিয়োজিত পরিবহন ও পণ্যবাহী যানবাহন ছাড়া অন্য কোনো যানবাহনকে গাবতলী হয়ে বের হতে কিংবা ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। অত্যন্ত জরুরি কারণ ছাড়া ব্যক্তিগত কোনো গাড়ি চলতে দেয়া হচ্ছে না।

চেকপোস্টে কড়াকড়ির কারণে এলাকার সড়কে গাড়ি চলাচল সীমিত হলেও চাপ বেড়েছে। গাবতলী চেকপোস্ট কৌশলের পেরিয়ে আমিনবাজার ব্রিজের আগেই পুলিশের চেকপোস্টে আটকা পড়েন মোটরসাইকেল চালিয়ে গ্রামের বাড়ি নাটোরের উদ্দেশে রওনা দেয়া আমিরুল ইসলাম। সেখানে তাকে ফেরত পাঠিয়ে দেয় পুলিশ। তিনি বলেন, ঢাকার মগবাজারে একটি বাসায় থাকি। বউ-বাচ্চাকে আগেই বাড়িতে পাঠিয়েছি। পুরো রমজানে খাওয়ার কষ্ট হচ্ছিল। ঈদও আসন্ন তাই মনটা বিষণœ। বাধ্য হয়ে মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে নাটোর যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। পুলিশ আটকে দিল। মিরপুর দারুস সালাম জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মাহমুদা আফরোজ লাকী বলেন, ‘যথাযথ কারণ ছাড়া একটি যানবাহনও আমরা ছাড়তে দিচ্ছি না। কঠোরভাবে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। শুধুমাত্র পণ্যবাহী ও জরুরি কাজে নিয়োজিত পরিবহনকে ছাড় দেয়া হচ্ছে। যারা হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তাদেরও ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। তবে অনেকেই চেকপোস্ট ফাঁকি দিয়ে অলিগলি ও চিপাচাপা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

সেক্ষেত্রে আমাদের নজরদারি রাখা কঠিনই হচ্ছে।’ একই অবস্থা উত্তরা, টঙ্গী ও আব্দুল্লাহপুর সড়কেও। যানবাহন না থাকায় কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হেঁটে পুলিশের চেকপোস্ট পার হচ্ছে মানুষ। বগুড়ার মোহাম্মদ আলী তাদেরই একজন। তিনি বলেন, কীভাবে যাব জানি না। কিন্তু যেতে হবে। ঢাকায় থাকলে হয় করোনায় নয়তো না খেয়ে মরতে হবে। টঙ্গী থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, টঙ্গী সেতু দিয়ে পোশাক কারখানার শ্রমিকরা ঢাকা গাজীপুর আসছেন।

আবার ঢাকায় ফিরছেন। এই পোশাক শ্রমিকদের ভিড়ের মধ্যে গ্রামমুখী মানুষ মিশে গিয়ে টঙ্গী ব্রিজ পার হয়ে ঢাকা ছেড়েছে। আব্দুল্লাপুর চেকপোস্টে দায়িত্বরত ঢাকা মহানগর ট্রাফিক উত্তর বিভাগের এডিসি গোবিন্দ চন্দ্র পাল বলেন, ‘ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়া কোনো যানবাহনকে আমরা চেকপোস্ট পার হতে দিচ্ছি না। কঠোরভাবে মেইনটেইন করা হচ্ছে। প্রয়োজনে মামলা দিচ্ছি, গাড়ি রেকার করছি। সরকারের নির্দেশনা মানার জন্য হাঁটা যাত্রীদের নিরুৎসাহিত করে ফিরিয়ে দিচ্ছি।’

ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কেও ঈদে ঘরমুখো মানুষের চাপ। পুলিশ মহাসড়কের বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহন থামিয়ে মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। যদিও নানা অজুহাতে অনেকেই পেরিয়ে যাচ্ছেন চেকপোস্ট।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, ‘সরকার যে নির্দেশনা দিয়েছে তা বাস্তবায়নেও আইজিপি প্রতিটি ইউনিটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কঠোর হতে বলেছেন। সে আলোকে পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। দেশের গণমাধ্যম ও পুলিশ সবাইকে সচেতন করছে। করোনার ভয়াবহতা মানুষ প্রতিদিনই নতুন করে জানছে। তবুও নানা অজুহাতে বের হচ্ছে মানুষ। তবে পুলিশ সর্বোচ্চ মানবিক মূল্যবোধ ও সহিষ্ণুতা বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করছে।’

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!