গভার্বস্থা এবং ডায়াবেটিস
স্বাস্থ্য: গভার্বস্থায় যদি রক্তে গ্লুকোজ বা শকর্রা নিয়ন্ত্রণে না রাখা হয় তাহলে মা ও বাচ্চা দুজনের নানা রকম জটিলতা দেখা দিতে পারে; এমনকি বাচ্চার মৃত্যু হতে পারে। অথচ সঠিক চিকিৎসা পেলে এবং কিছু নিয়ম মেনে চললে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। রোগটি কী? কেন হয়? চিকিৎসা, চিকিৎসাপদ্ধতি, কখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত…
ডায়াবেটিস এবং গভার্বস্থা
বতর্মানে পৃথিবীতে মোট ডায়াবেটিক রোগীর কমপক্ষে ১৬.২ শতাংশ শুধু গভর্কালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অন্য দিকে প্রতি ৫ জন ডায়াবেটিস আক্রান্ত মহিলা প্রজনন সময়কালের মধ্যে আছেন। যাদের গভর্কালীন ডায়াবেটিস আছে পরবতীর্ ৫ বছরের মধ্যে এদের অেেধর্করও বেশি টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত হবেন, অধিকাংশ গভর্কালীন ডায়াবেটিস আক্রান্ত মহিলার বসবাস অনুন্নত দেশগুলোতে। গভর্বতীর ডায়াবেটিস তার নিজের ও গভর্স্থ শিশুর জন্য ব্যাপক ঝুঁকির কারণ।
গভার্বস্থায় যদি রক্তে গ্লুকোজ বা শকর্রা নিয়ন্ত্রণে না রাখা হয় তাহলে মা ও বাচ্চা দুজনের নানা রকম জাটিলতা দেখা দিতে পারে; এমনকি বাচ্চার মৃত্যু হতে পারে অথচ সঠিক চিকিৎসা পেলে এবং কিছু নিয়ম মেনে চললে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। রোগটি কী? কেন হয়? চিকিৎসা, চিকিৎসা পদ্ধতি, কখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত ইত্যাদি বিষয়ে উল্লেখ করা হলোÑ
ডায়াবেটিস কী?
-রক্তে শকর্রার পরিমাণ যতি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিমাণে থাকে তাহলে তাকে ডায়াবেটিস বলা হয়।
-গভর্কালীন সময়ে কেন রক্তে শকর্রার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি?
-গভর্কালীন সময়ে মা এবং বাচ্চার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। গভার্বস্থায় মায়ের ডায়াবেটিস যদি অনিয়ন্ত্রণ থাকে তাহলে ডায়াবেটিসের কারণে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মায়ের ব্লাড সুগার যদি নিয়ন্ত্রণে থাকে তাহলে পেটের বাচ্চার স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে। গভার্বস্থায় মায়ের ব্লাডে যদি সুগারের পরিমাণ বেশি থাকে তাহলে বড় বাচ্চা হতে পারে। হঠাৎ করে বাচ্চা পেটের মধ্যে মরে যেতে পারে, পেটে পানি আসতে পারে, ডায়াবেটিসের কারণেও প্রেসার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সে জন্য প্রেসার এবং ডায়াবেটিস দুটোই যদি অনিয়ন্ত্রণে থাকে তখন ডেলিভারি ডেট পযর্ন্ত পাওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে প্রিমেচিউর ডেলিভারি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ছাড়া গভর্কালীন সময়ে ব্লাডে সুগার যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তখন ডেলিভারির পর পরই বাচ্চার রক্তের গ্লুকোজ কমে যায়। সেহেতু বাচ্চাকে ইনসুলিন দিয়ে বাচ্চার ব্লাডে সুগার কন্ট্রোল করা হয়। মাকে ইনসুলিন দিয়ে বাচ্চার ব্লাডে সুগার কন্ট্রোল হয় না। এমনকি কয়েক মিনিটের মধ্যে ব্লাড সুগার শূন্য হয়ে যায়। ব্লাড সুগার শূন্য হয়ে গেলে বাচ্চার নানা রকম সমস্যা যেমন, খিঁচুনি, শ্বাসকষ্টসহ নানা রকম জটিলতা হতে পারে। এ জন্যই গভর্কালীন সময়ে মায়ের ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করা খুবই জরুরি।
গভার্বস্থায় কাদের ডায়াবেটিস হওয়ার বেশি সম্ভাবনা থাকে।
-যাদের শরীরের ওজন অধিক হয়, ডায়াবেটিস বংশে আছে, পূবর্বতীর্ গভর্কালীন সময়ে যাদের ডায়াবেটিস ছিল, পূবের্ বড় বাচ্চা প্রসব করেছিল; প্রিমেচিউর, কারণ ছাড়া বাচ্চা পেটে মারা গিয়েছিল, বেশি বয়সে গভর্ধারণ ইত্যাদি অবস্থায় ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
ডায়াবেটিস গভর্কালীন মহিলার ওপরে কীরকম প্রভাব ফেলতে পারে?
-গভর্কালীন সময়ে ডায়াবেটিস দুই ধরনের হয়ে থাকে।
প্রথমত, প্রিজেস্টেশনাল ডায়াবেটিস বা গভার্বস্থায় আগে থেকেই যাদের ডায়াবেটিস ছিল এবং দ্বিতীয়, গভার্বস্থায় কারণে ডায়াবেটিস বা জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস, গভার্বস্থায় গ্লুকোজ বা শকর্রা নিয়ন্ত্রণে না নিয়ে যদি গভর্ধারণ করা হয় তাহলে মা ও বাচ্চা দুজনের নানা রকম জটিলতা দেখা দিতে পারে। মায়ের যেমন প্রিএকলামসিয়া, একলামসিয়া বা খিঁচুনি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে; ডেলিভারির সময় প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে পারে। বাচ্চা পরিপক্ব হওয়ার আগেই প্রসব হয়ে যেতে পারে, বাচ্চার পানির থলিটা ফেটে যেতে পারে। বড় বাচ্চা হওয়ার কারণে অপারেশন করার প্রয়োজন বেশি হয়।
ডায়াবেটিস গভের্র বাচ্চার ওপর কীরকম প্রভাব ফেলে?
-প্রেগন্যান্সির আগে থেকেই যদি ডায়াবেটিস থাকে তাহলে গভর্পাত হয়ে যেতে পারে। বাচ্চা হঠাৎ করে বড় হয়ে যেতে পারে, মায়ের যে থলিতে বাচ্চাটা থাকে সেখানে পানি বেশি থাকতে পারে, বাচ্চার হাটের্র সমস্যা যেমন, ছিদ্র থাকতে পারে, বাচ্চা শুধু বড় হবে তা নয় ছোটও হতে পারে, হাটের্র বড় রক্তনালিগুলো উল্টাপাল্টা থাকতে পারে। কিডনি তৈরি নাও হতে পারে। অথবা এক পাশের কিডনি নাও থাকতে পারে। এ কারণগুলো ছাড়াও বাচ্চা হঠাৎ করেই পেটে মারা যেতে পারে। খিঁচুনি হতে পারে, এ কারণগুলো ছাড়াও বাচ্চা হঠাৎ করেই পেটে মারা যেতে পারে। খিঁচুনি হতে পারে, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়ামের অভাব হতে পারে। সেন্ট্রাল লভার্স সিস্টেমে মাথার খুলি তৈরি নাও হতে পারে, খাদ্যনালি বন্ধ থাকতে পারে।
মায়ের ডায়াবেটিসের কারণে প্রসবের পর পরই বাচ্চার কী কী সমস্যা থাকতে পারে?
-প্রসবের পরপরই নবজাতক জন্মগত নানা ত্রুটি নিয়ে জন্ম নিতে পারে। তা ছাড়া রক্তে গ্লুকোজ কমে যেতে পারে, এমনিতি শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে, হায়ালিন মেমব্রেন ডিজিজের কারণে প্রচ- শ্বাসকষ্ট হতে পারে, জন্ডিস হতে পারে।
-গভর্বতী অবস্থায় যে ডায়াবেটিস হয় ডেলিভারির পর তা কি থাকে?
-গভর্বতী হওয়ার পর যে ডায়াবেটিস হয় ডেলিভারির পর পরই চলে যায়। ডেলিভারির ছয় সপ্তাহ পর আবার আমরা ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাইয়ে দুই ঘণ্টা পর রক্তে গ্লুকোজ মাপি। কারো কারো প্রেগন্যান্সির পর ডায়াবেটিস থেকে যায়। ৪০ ভাগ থেকে ৬০ ভাগ হারে ৫০ বছর বয়সে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা যাদের গভার্বস্থায় ডায়াবেটিস ছিল। সুতারাং ওজন যদি নিয়ন্ত্রণে থাকে, খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম করার অভ্যাস করলে পরবতীর্ সময়ে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
কীভাবে গভর্কালীন মহিলার ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করা যায়?
-প্রেগন্যান্সির পর যে ডায়াবেটিস হয় তা সাধারণত ব্যায়াম এবং খাদ্যাভাস পরিবতের্নর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাতে সবসময় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ হয় না, সে ক্ষেত্রে ইনসুলিন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যাদের প্রেগন্যান্সির আগ থেকে ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে আমরা ইনসুলিন দিয়ে ব্লাড সুগারটা কন্ট্রোল করি।
ওরালি বা এ জাতীয় ট্যাবলেট যদি দেয়া হয়:
-গভর্কালীন মা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ট্যাবলেট খেয়ে আমাদের কাছে আসে তা ওই দিনই বন্ধ করতে হবে। প্রেগন্যান্সির সময় ট্যাবলেট দিয়ে রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করলে বাচ্চার নানা রকম জটিলতা এমনকি অঙ্গহানি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
কেন প্রসবকালীন রক্তে শকর্রার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি?
-মায়ের যদি ব্লাডে সুগার বেশি হয় তখন কিন্তু বাচ্চার শরীরে বেশি বেশি গ্লুকোজ যাবে। আর বাচ্চার তো নিজস্ব ইনসুলিন দিয়েই গ্লুকোজ কন্ট্রোল করবে। আর বাচ্চার শরীরে বেশি গ্লুকোজ যাওয়ার কারণে বেশি ইনসুলিন তৈরি হবে। ডেলিভারির পর মায়ের গ্লুকোজ বাচ্চা আর পাবে না এবং বাচ্চার শরীরে প্রয়োজনের অধিক ইনসুলিন থাকবে এবং বাচ্চার গ্লুকোজ কমে যাবে। এতে বাচ্চার খিঁচুনি শ্বাসকষ্টসহ নানা রকম জটিলতা হতে পারে। আর মায়ের যদি ব্লাড সুগার কন্ট্রোল না থাকে তাহলে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
প্রসবের পর নবজাতক শিশুর যতœ কীভাবে করা হয়?
-ডেলিভারির পর পরই রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করতে হবেÑ যেন কমে না যায়। বাচ্চা ডেলিভারি হওয়ার ১ ঘণ্টা পর ব্লাড টেস্ট করে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ দেখা হয়। এভাবে কিছু সময় অন্তর অন্তর রক্তের গ্লুকোজ মাপা হয়। যদি দেখা যায়, বাচ্চার ব্লাড সুগার কমে যাচ্ছে তখন গ্লুকোজ ইউফিউশন দিয়ে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
গভর্কালীন ডায়াবেটিস আক্রান্ত মায়ের খাদ্য তালিকা কেমন হওয়া উচিত?
-গভার্বস্থায় মায়ের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। সে ক্ষেত্রে শকর্রা ৫০% থেকে ৬০% অনুপাত হারে ক্যালরি নেয়া যেতে পারে।
-গভার্বস্থায় রক্তে শকর্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য পরীক্ষা করা হয়। সেটা ল্যাবরেটরিতে করা যায়। সবচেয়ে ভালো হয়, হোম ব্লাড সুগার মাপার জন্য গ্লুকোমিটার কিনে নিলে। কারণ ৩ বেলা খাওয়ার দুঘণ্টা পর এবং সকালে অভুক্ত অবস্থায় শকর্রার পরিমাপ করতে হয়। বাড়িতে বসেই গ্লুকোমিটার দিয়ে চেক করলে ল্যাবরেটরিতে প্রতি বেলায় যেতে হয় না। এ ছাড়া কম খরচেও বাড়িতে গ্লুকোমিটার দিয়ে চেক করতে পারে।
দুগ্ধদানকালীন ডায়াবেটিস চিকিৎসা কীভাবে করা হয়?
-চিকিৎসা পদ্ধতি একই। গভর্কালীন মায়েদের ব্লাড সুগার কন্ট্রোল রাখা হয়। ডেলিভারির পর আমরা ছয় সপ্তাহ পর প্রেগন্যান্সির আগে যে ওষুধ সেবন করা হয় সেটা শুরু করতে পারি।
গভর্কালীন অবস্থায় ডায়াবেটিসের বেশি খরচ হয় কিনা?
-সাধারণ প্রেগন্যান্সির সময় মায়েদের যে রকম খরচ সে রকম খরচই হয়, শুধু ইনসুলিনের জন্য একটু বেশি খরচ হয়। তা ছাড়া নবজাতকের জটিলতা যেহেতু সাধারণ গভার্বস্থার চেয়ে বেশি, সে কারণে যদি ইনকিউবেটরে রাখার প্রয়োজন হয় সে ক্ষেত্রে খরচের পরিমাণও অধিক মাত্রায় বেড়ে যায়।