টেকসই উন্নয়নে সুশাসন ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে

সালেহউদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশ এখন একটি বিশেষ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, যেটাকে আমরা বলি ক্রিটিক্যাল ক্রস রোড। এটা বলার কারণ হচ্ছে, আমাদের এখানে প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবেই হচ্ছে। ১৯৯০ সালের পর থেকে বিভিন্ন সরকারের আমলে প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। আর এই যে উন্নয়ন, সেটা সব জায়গায় সমানভাবে স্বীকৃত এবং বিশ্বের অন্যান্য জায়গায়ও স্বীকৃতি পাচ্ছে। একই সঙ্গে এখানে একটি দরকারি কাজ আছে; সেটা হচ্ছে এই উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে এবং সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সমতাভিত্তিক উন্নয়ন, জনগণের উপকারার্থে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির ভারসাম্য, গণতন্ত্র এবং সুশাসন দরকার, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা দরকার। সেটার ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। এখানে দুটি চ্যালেঞ্জÑপ্রথমত প্রবৃদ্ধিটাকে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। আর সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রক্রিয়াটি টেকসই করার জন্য যে সাপোর্ট দরকার, তা হলো নীতি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাজারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দিতে হবে। সব মিলিয়ে বিষয়গুলো যদি বিবেচনা করি, সেদিক থেকে আমাদের একটা ক্রান্তিকাল চলছে। এই সময়ে এসে বিষয়গুলোর প্রতি যদি আমরা সঠিকভাবে নজর দিই এবং সমাধান করার চেষ্টা করি, সরকারে যে-ই আসুক এবং দেশ পরিচালনা করুকÑএ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। তাহলে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির গতিশীলতা ধরে রাখা সহজ হবে। এই ক্রান্তিকালে ভুল হলে মাসুল দিতে হবে প্রচুর, দেশ আবার পেছনের অন্ধকার দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারে।
এখন আসি প্রবৃদ্ধির বিষয়ে। আমরা বলছি যে প্রবৃদ্ধিতে আমরা ভালো করছি। এটা ভালো খবর। ছয়ের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে আমরা সাতের ভেতরে প্রবেশ করছি। আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি যে রপ্তানি ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে এবং বহুমুখী হচ্ছে। রেমিট্যান্স মাঝখানে একটু কম ছিল, সেটা বেড়েছে। বাংলাদেশের মানুষ বাইরে যাচ্ছে। হয়তো সেটার গতি ও সংখ্যা কমবেশি হতে পারে, কিন্তু যাওয়াটা থমকে নেই, অব্যাহত আছে। অর্থনৈতিক কর্মকা-ও থেমে নেই। কিন্তু এখানে কতগুলো চ্যালেঞ্জ আছে। প্রবৃদ্ধির ওপর নজর দেওয়া, এর গ্রোথ ও সূচকের ওপরে খেয়াল রাখা। এটি একটি সূচক মাত্র। সূচকের দিকে নজর দেওয়া, আমি মনে করি, এ বিষয়ে অত্যধিক নজর দেওয়া হচ্ছে। প্রবৃদ্ধির হিসাবটা যখন ক্যালকুলেট করা হয়, তখন কিন্তু মোট দেশজ আয় এবং সবার হরেদরে আয়কে ধরা হয়। সে ক্ষেত্রে একজন রিকশাওয়ালার যে আয় এবং কোটিপতির আয়, সেটার একটা গড় বের করা হয়। এটা কিন্তু রিফ্লেক্ট করে না যে সাধারণ মানুষের ইনকাম বেড়েছে, না কমেছে। বিশেষ করে সামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে কি না, সেটার কোনো রিফ্লেক্ট এতে পড়ছে কি না তা বোঝা যায় না। সুতরাং আমরা এখন প্রবৃদ্ধি দেখছি, কিন্তু সমতাভিত্তিক উন্নয়ন দেখছি নাÑএ বিষয়ে নজর দেওয়া। ফলে দিন দিন কিন্তু ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে। আয়ের বৈষম্য বাড়ছে, সম্পদের বৈষম্য আরো বাড়ছে। মানুষের মধ্যে যারা ধনী, তাদের বাড়িঘর ও বিভিন্ন ধরনের যে সম্পদ-অর্থ আছে সেগুলো বাড়ছে। তাদের আয়ের দিকটাও আপেক্ষিকভাবে দ্রুতগতিতে বাড়ছে।
এ বিষয়টি যদি এখন থেকেই আমরা নিয়ন্ত্রণ না করি, তাহলে কিন্তু আমরা পিছিয়ে পড়ব। বাংলাদেশ যে আদর্শে হয়েছিল, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর যে ডিকলারেশন ছিল ছয় দফার, তার একটি হচ্ছে রাজনৈতিক স্বাধিকার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়। দুটিই কিন্তু একসঙ্গে ছিল। আর অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য রাজনৈতিক স্বাধিকার দরকার। এই দুটি বিষয় পাশাপাশি রেখে গুরুত্ব দিতে হবে।
আমাদের সামনে এখন যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো আছে, তা কিন্তু শুধু প্রবৃদ্ধি দিয়ে চলবে না। আবার মূল্যস্ফীতি রোধ করেও কাজ হবে না। কারণ মানুষের যদি আয় না থাকে, তাহলে আয়ের সংস্থান না থাকলে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে লাভ হবে না। এখন আমাদের করণীয় হচ্ছেÑঅর্থনৈতিক উন্নতির ফল সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছাতে হবে, যুক্তিসংগত আপেক্ষিকভাবে যেন ভালোভাবে পৌঁছে তা নিশ্চিত করতে হবে। একজন ধনীলোক কন্ট্রিবিউট করেছে, সে যেমন সুবিধা পাবে; একজন গরিব লোক যে দিনরাত পরিশ্রম করছে, সে-ও কিছুটা সুবিধা পাক। আপেক্ষিকভাবে কিন্তু বৈষম্য বাড়ছে। বাংলাদেশে খেয়াল করলে দেখা যাবে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের যে অর্থনৈতিক ইনডিকেটর আছে, সে তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। ফলে এখানে কিন্তু ধনী-গরিবের বৈষম্যও তাই বেশি। সুইডেন, নরওয়ে, আমেরিকা বা ইংল্যান্ডসহ অনেক দেশ আছে, সেখানেও বৈষম্য আছে কিন্তু এত বেশি নেই।
সামাজিক উন্নতির জন্য আমাদের অর্থনৈতিক ইনভেস্টমেন্ট দরকার। অর্থনৈতিক গ্রোথ দরকার। এসবের পাশাপাশি আরো যে জিনিসগুলোর প্রতি আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে সেগুলো হচ্ছেÑশিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থান। এগুলোর প্রতি গুরুত্ব কম। এগুলোর প্রতি জোর বাড়াতে হবে। শিক্ষার প্রতি আমাদের বাজেট বেশি বলা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার জন্য বরাদ্দের হার জিডিপি বা দেশজ আয়ের অংশের যৎসামান্য। আমাদের জাতীয় আয়ের ৪-৫ শতাংশও নয়। কোরিয়ার মতো দেশে উন্নতি হয়েছে শিক্ষার উন্নতি দিয়েই। তাদের শিক্ষার জন্য বাজেট ১২ থেকে ১৪ শতাংশেরও বেশি। আর আমাদের এখানে শিক্ষা খাতে যে ব্যয় হয় তা বেতন-ভাতার মধ্যে চলে যায়। আর বিল্ডিংয়ের জন্য ব্যয় হয়। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, ক্লাসরুমের উন্নয়ন, টেক্সট বুকের মানের জন্য গুরুত্ব কম। আবার স্বাস্থ্য খাতে দেখা যাচ্ছে, সেখানে সেবা এত অপ্রতুল; সরকারি হাসপাতালে যে সেবাগুলো আছে তা তো গরিব মানুষ ঠিকমতো পায় না। কমিউনিটি ক্লিনিক করা হয়েছে, সেখানে তো ডাক্তার নেই, ভালো কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। হিসাবে বলা যায় যে স্বাস্থ্য খাতের সেবা এখন প্রাইভেট ও বেসরকারি খাতে চলে গেছে এবং এ ক্ষেত্রে প্রচুর ব্যয়। এটি তো আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমাদের এখানে স্বাস্থ্য খাতের আউট অব পকেট ব্যয় সীমার বাইরে চলে গেছে। ১০০ টাকা খরচ হলে ৬০ টাকা দিতে হয় রোগীদের। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কিন্তু এমনটা নেই। নরওয়ে বা সুইডেনের মতো দেশে এক হাজারে তো দুই টাকাও দিতে হয় না। কারণ সেটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা করে। একটা জরুরি কথা হচ্ছে, মানবসম্পদ উন্নয়নের একটা বড় উপায় হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্ব দেওয়া। এটা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত ও অবলম্বন। আবার বাসস্থানের ক্ষেত্রে আমরা হৈচৈ করছি, কিন্তু এ বিষয়েও সুপরিকল্পিত কোনো ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা যায়নি।
এখন আসি সরকারের যে নীতিমালা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো সব সময় সহায়ক কি না সাধারণ মানুষের জন্য? সরকারের যে বাজেট, নীতি ও কর্মপরিকল্পনা থাকে, সেগুলো তো মনে হচ্ছে শুধু অর্থনৈতিক উন্নতি এবং এর সুবিধাগুলো ভোগ করছে মুষ্টিমেয় কিছু লোক, যারা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে; যারা সরকারি প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের জন্য। তাদের সামাজিক যোগাযোগ ও প্রতিপত্তি বেশি, সুযোগগুলো তারাই বেশি পাচ্ছে। এই সুবিধাগুলো যারা পাচ্ছে, ধরা যাক সরকারের যে রাজস্ব পলিসি, এটা হচ্ছে সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম একটা হাতিয়ার, যা হওয়া উচিত সমতাভিত্তিক একটি উন্নত সমাজের জন্য। এখন কারা আয়কর দেবেন? নিয়ম হচ্ছে যাঁরা ধনী এবং বড় বড় ব্যবসা করেন তাঁরা ট্যাক্সটা বেশি করে দেবেন। কিন্তু হচ্ছে তার উল্টোটা। আমাদের দেশে যাঁরা যত ওপরের দিকে যাবেন, তাঁদের তুলনামূলক ট্যাক্স কম। সে তুলনায় গরিব এবং যাঁদের আয় কম তাঁরা কিন্তু পরোক্ষভাবে বিভিন্ন রকমের করের ভার বহন করছেন বেশি। এখানে একটা ব্যাপার আছে, অনেকে সুযোগ পেলেই ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছে, কারণ সরকারের সুসংহত এবং শক্ত কোনো প্রচেষ্টা নেই যে ট্যাক্স নিয়মিত বা বেশি দিলে তিনি কোনো সুবিধা পাবেন বা ট্যাক্স ফাঁকি দিলে শাস্তি দেওয়া হবে। ট্যাক্স দেওয়ার নিয়ম কীÑট্যাক্সটা দেওয়া হয় দেশে সর্বজনীনভাবে সেবা ও সুবিধা নিশ্চিত করতে। একজন বড়লোক, যিনি ট্যাক্স দিয়ে বলতে পারবেন না যে আমার বাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা বা লাইটপোস্ট তৈরি করে দাও। এটা বলতে পারবেন না। বরং এক জায়গার ট্যাক্স আদায় করে আরেক জায়গায় কাজ করবে, যেখানে কাজের দরকার। কিন্তু সার্বিকভাবে বলা যায়, রাজস্ব আদায় করে সমাজ ও মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। কাজ না করাটা এক ধরনের ভুল। তা না হলে মানুষ কেন ট্যাক্স দেবে। এসব বিষয় নিশ্চিত করতে না পারলে মানুষের মধ্যে ট্যাক্স দেওয়ার উৎসাহ ও প্রবণতা বাড়বে না। এ ক্ষেত্রটা বাড়াতে হবে। সমাজে যারা প্রভাবশালী তারা শুধু সুবিধা পাবে, আর যারা উদয়াস্ত শ্রম দিয়ে ছোট ছোট ব্যবসা করে, যাদের কোনো কার্যকরী সংগঠন নেই, তারা কোনো সুবিধা পায় না, তারা সরকারি সহায়ক নীতি এবং সুবিধার বাইরেই থেকে যায়।
আরেকটি বড় বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলোর দক্ষতা ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে। সারা বছর দায়সারা গোছের কাজ চলছে কিন্তু কোনো দায়বদ্ধতা নেই, জবাবদিহি নেই। এতে কিন্তু সাধারণ জনগণ বঞ্চিত হয় এবং এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়, যাতে বঞ্চনা ও অবিচার বাড়ছে। এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা ৪৭ বছরে এত দূর এসেছি। সামনে দেশকে বিশ্বের দরবারে আরো দ্রুত এগিয়ে নিতে হলে উন্নয়ন ও উদ্যোগের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে গণতন্ত্র, সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে সমতাভিত্তিক, টেকসই এবং কল্যাণমুখী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। কালক্ষেপণ, অজুহাত আর জনগণকে অবহেলা নয়, দেশটিই জনগণের এবং সেটিই হবে মূলমন্ত্র।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!