ট্রলারডুবিতে নিখোঁজ ভাঙ্গুড়ার ১৮ শ্রমিকের পরিবারে শোকের মাতম

নিজস্ব প্রতিবেদক, পাবনা : মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার কালিয়াপুর এলাকার মেঘনা নদীতে মাটি বোঝাই ট্রলারডুবির ঘটনায় নিখোঁজ পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার ১৮ শ্রমিকের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। স্বজন হারিয়ে বাকরুদ্ধ অনেকেই। কারো সন্তান, কারো স্বামী আবার কারো বাবার সন্ধান না পেয়ে আহাজারী থামছে না তাদের।
বুধবার দুপুরে সরেজমিনে ভাঙ্গুড়া উপজেলার খানমরিচ ইউনিয়নের মুন্ডুমালা, মাদারবাড়িয়া, চন্ডিপুর ও দাসমরিচ গ্রামে গিয়ে দেখা যায় এমন পরিবেশ। গ্রামগুলো যেন এখন শোকের গ্রাম। নিখোঁজ শ্রমিক মানিক হোসেনের স্ত্রী রুমা খাতুন স্বামীকে ফিরে পেতে বিলাপ করছেন। বলছিলেন, আপনারা আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিন। আমি এই বয়সে বিধবা হতে চাইনা ? আমার দুই সন্তানকে কে দেখবে। আমার দুই ছেলে কাকে বাবা বলে ডাকবে?
সন্তানের নিখোঁজ সংবাদে বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন নিখোঁজ তুহিন হোসেনের বাবা ছায়দার আলী। তুহিনের নব্য বিবাহিত স্ত্রী মুসলিমা খাতুন হারিয়ে ফেলেছেন কথা বলার ভাষা। শুধু চেয়ে আছেন বাড়িতে আসা লোকজনের দিকে। শুধু মানিক বা তুহিন ই নন, এমন পরিস্থিতি চারটি গ্রামের নিখোঁজ ১৮ জনের পরিবারে। শোকের চাদরে ঢাকা পড়েছে গ্রামগুলোর পরিবেশ। নিখোঁজ স্বজনদের স্বান্তনা দিতে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না প্রতিবেশি ও এলাকাবাসী।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা জানান, গত ১১ দিন আগে একই ইউনিয়নের মাদরবাড়িয়া গ্রামের মাটি কাটার সরদার আবদুল হাই দাদন দিয়ে শ্রমিকদের নারায়গঞ্জের বক্তারখালী এলাকায় মাটি কাটার কাজে নিয়ে যায়। এরপর মঙ্গলবার (১৫ জানুয়ারি) ভোররাতে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে ট্রলারে মাটি নিয়ে নারায়নগঞ্জের বক্তারখালী এলাকায় যাচ্ছিলেন শ্রমিকরা। ট্রলারে থাকা শ্রমিকের মধ্যে কেউ ঘুমিয়েছিলেন, কেউবা জেগে। পথিমধ্যে ভোররাত সাড়ে ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে ট্রলারটি মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার উপজেলার সীমান্তবর্তী কালিয়াপুর এলাকার মেঘনা নদীতে পৌঁছার পর একটি মালবাহী জাহাজের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ট্রলারটি ডুবে যায়। ট্রলারে থাকা শ্রমিকদের মধ্যে ১৪ জন সাঁতার জানায় প্রাণে বাঁচলেও ১৮ জন নিখোঁজ হয়।
বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার খানমরিচ ইউনিয়নের চন্ডিপুর গ্রামের হাশেম আলীর ছেলে মামুন আলী প্রামানিক ও পাইকপাড়া গ্রামের আশরাফ মোল্লার ছেলে শাহ আলম জানান, ট্রলারের মাথার দিকে ছিলেন মামুন আর পেছনের দিকে ছিলেন শাহ আলমসহ বাকিরা। ট্রলার ডুবে যাওয়ার মুহুর্তে আমরা ১৪ জন উঠে আসতে পারলেও অন্যরা পারেনি।
মামুন ও শাহ আলম আরো জানান, ওই সময় চারিদিকে অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। ৩ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে আমরা ঠান্ডা পানির মধ্যে সাঁতরে ভেসে ছিলাম। মনে হচ্ছিল মৃত্যু খুব কাছে। পরিবারের কথা মনে পড়ছিল। আর ১০ মিনিট পানিতে থাকলে মারা যেতাম। মাটির ট্রলার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গন্তব্যে না পৌঁছার কারণে মালিক পক্ষ মোবাইলে ফোন দিয়ে বন্ধ পায়। সন্দেহ হলে তখন তারা আরেকটি ট্রলার নিয়ে এসে আমাদের উদ্ধার করে।
নিখোঁজ ১৮ জন শ্রমিক হলেন, পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার খানমরিচ ইউনিয়নের মুন্ডুমালা গ্রামের গোলাই প্রামানিকের ছেলে ছোলেমান হোসেন, জব্বার ফকিরের ছেলে আলিফ হোসেন ও মোস্তফা ফকির, গোলবার হোসেনের ছেলে নাজমুল হোসেন-১, আব্দুল মজিদের ছেলে জাহিদ হোসেন, নুর ইসলামের ছেলে মানিক হোসেন, ছায়দার আলীর ছেলে তুহিন হোসেন, আলতাব হোসেনের ছেলে নাজমুল হোসেন-২, লয়ান ফকিরের ছেলে রফিকুল ইসলাম, দাসমরিচ গ্রামের মোশারফ হোসেনের ছেলে ওমর আলী ও মান্নাফ আলী, তোজিম মোল্লার ছেলে মোশারফ হোসেন, আয়ান প্রামানিকের ছেলে ইসমাইল হোসেন, সমাজ আলীর ছেলে রুহুল আমিন, মাদারবাড়িয়া গ্রামের আজগর আলীর ছেলে আজাদ হোসেন, চন্ডিপুর গ্রামের আমির খান ও আব্দুল লতিফের ছেলে হাচেন আলী এবং উল্লাপাড়া উপজেলার গজাইল গ্রামের তোফজ্জল হোসেনের ছেলে রহমত আলী।
এদিকে, বুধবার বিকেলে জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিনের নির্দেশে নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবারের খোঁজ নিতে যান ভাঙ্গুড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাসুদুর রহমান। এ সময় তিনি প্রত্যেক পরিবারকে শুকনো খাবার ও শীতবস্ত্র হিসেবে কম্বল বিতরণ করেন। তিনি জানান, নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবারের খবর আমরা নিয়মিত রাখবো। তাদের পাশে দাঁড়াতে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!