তিন দিনের মাথায় ধরনা তুলে নিলেন মমতা
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : তিন দিনের মাথায় গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ধরনা তুলে নিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সকালে আদালতের নির্দেশনার পর সন্ধ্যায় ধরনা তুলে নেন মমতা। তবে তিনি বলেছেন, ১৩ এবং ১৪ তারিখ দিল্লিতে ধরনা হবে। সংবিধান এবং গণতন্ত্র রক্ষায় এ পদক্ষেপ। কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার জেরার প্রতিবাদে এ ধরনায় অংশ নিয়েছিলেন মমতা। তবে গত মঙ্গলবার সকালে সুপ্রিম কোর্টের এক নির্দেশনায় বলা হয়, সারদা চিট ফান্ড মামলায় কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে জেরা করতে পারবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। তবে সেই জেরা হবে নিরপেক্ষ জায়গায়; দিল্লি বা কলকাতা নয়, হবে মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, জেরা করলেও কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে গ্রেফতার করতে পারবে না সিবিআই। আদালতের এমন ঘোষণার পর বিকালে পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার সিবিআইকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন যে, তিনি ৮ ফেব্রুয়ারি শিলংয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যেতে প্রস্তুত রয়েছেন। পরে সন্ধ্যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, আদালতের রায় আমাদের নৈতিক জয়। তাই সংবিধান বাঁচাও নামের এই ধরনা এখানেই শেষ করছি। কিন্তু আগামি সপ্তাহে দিল্লিতে আমি ধরনায় বসব। অন্যদিকে গত রোববার রাতে যখন কলকাতার ধর্মতলায় ধরনা শুরু করেন মমতা ব্যানার্জী, সেখানে হাজির হয়ে চাকরির নিয়ম ভঙ্গ করেছেন রাজীব কুমার। এই কথা জানিয়ে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরুর নির্দেশ দিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রাজীব কুমার ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের কর্মকর্তা এবং তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেই পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারে নিযুক্ত হয়েছেন। সেই চাকরির নিয়ম অনুযায়ী কোনও রাজনৈতিক দলে বা রাজনৈতিক জমায়েতে যোগ দিতে পারেন না আইপিএস অফিসাররা। মমতার বিরোধীদের দাবি, সেই নিয়মই ভঙ্গ করেছেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার। তবে মমতা বলছেন, ধরনা মঞ্চে রাজীব কুমার কখনই হাজির হননি। ওই জায়গায় সরকারি কাজে গিয়েছিলেন তিনি। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই-এর অভিযোগ, সারদা চিট ফান্ড মামলায় তদন্তের সময় রাজীব কুমার বেশ কিছু নথি এবং প্রমাণ বাজেয়াপ্ত করেছিলেন, কিন্তু সেগুলো সিবিআইকে দেওয়া হচ্ছে না। একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হলেও রাজীব কুমার কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের সামনে হাজির হননি। সারদা নামের সংস্থাটি বেআইনিভাবে লাখ লাখ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কয়েক হাজার কোটি রুপি সংগ্রহ করেছিল। ২০১৩ সালে ওই সংস্থার বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করা হয়। কাশ্মীরের গুলমার্গ থেকে গ্রেফতার করা হয় সারদার মালিক সুদীপ্ত সেন আর তার সহযোগী দেবযানী মুখার্জীকে। ওই মামলার প্রাথমিক তদন্তভার ছিল যে বিশেষ দলের ওপর তার প্রধান ছিলেন এখনকার কলকাতা পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার। পরে সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ দায়ের হয় যে, কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাকে ওই মামলার দায়িত্ব দেওয়া হোক। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যে, সারদা যেভাবে অর্থ সংগ্রহ করেছে, তার পেছনে মদদ ছিল প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের। ভারতের শীর্ষ আদালতও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দেয় সিবিআইকে। এরমধ্যেই গত রোববার আকস্মিকভাবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা নাটকীয়ভাবে পুলিশ কমিশনারের সরকারি বাসভবনের সামনে হাজির হন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। কলকাতা পুলিশ প্রথমে বাধা দেয় তদন্তকারীদের। পরে সিবিআই অফিসারদের টেনে হিঁচড়ে থানায় নিয়ে যায়। গত রোববার সন্ধ্যা থেকে ঘটতে থাকে একের পর এক নাটকীয় ও অভাবনীয় ঘটনা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে গিয়ে বৈঠক করেন অন্য শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে। সেখান থেকে বেরিয়ে মমতা ঘোষণা দেন, তিনি এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে ধরনায় বসছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির নির্দেশেই তার প্রশাসনের ওপরে আক্রমণ চালানো হচ্ছে। নিজের রাজ্যে সরকারি বাহিনীর পাশে থাকার বার্তা দিয়ে মমতা বলেন, ওই ঘটনা সাংবিধানিক কাঠামোর ওপরে সরাসরি আঘাত। মমতার এই অবস্থানকে ভারতের সব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন দিয়েছে। যেভাবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের কাজে বাধা দেওয়া হয় আর তাদের থানায় আটক করে রাখা হয়, সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে আদালত অবমাননারও অভিযোগ করা হয়েছে। যেহেতু শীর্ষ আদালতের নির্দেশেই তারা তদন্ত চালাচ্ছিল তাই তদন্তকারীদের বাধা দেওয়া আদালত অবমাননার শামিল। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এ ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিব, পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল এবং কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে নোটিস দিয়েছে। ২০ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী শুনানির আগেই পশ্চিমবঙ্গের তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে জবাব দাখিল করতে হবে।
দারোগা আর কোতোয়াল যখন মুখোমুখি : ভারতে সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই কাগজে-কলমে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ একটি সংস্থা হলেও তারা যে আসলে পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রী তথা কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে সেটা কোনও গোপন কথা নয়। সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত কয়েক বছর আগে সিবিআই-কে ‘খাঁচায় বন্দি তোতাপাখি’ বলে বর্ণনা করেছিল- অর্থাৎ যারা নিজেরা ইচ্ছেমতো চলাফেরা করতে পারে না, সরকারের শেখানো বুলিই যাদের বলতে হয়। সেই সিবিআইয়ের একদল কর্মকর্তা গত রোববার সন্ধ্যায় কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বাংলোতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য এসে হাজির হন। রাজীব কুমার ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের অফিসার, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ। কিন্তু তিনি এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে কাজ করছেন, কলকাতার পুলিশ-প্রধান হিসেবে তিনি মুখ্যমন্ত্রীরও অতি আস্থাভাজন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই যখন চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির তদন্ত হাতে নেয়, তারা রাজীব কুমারের বিরুদ্ধে প্রমাণ লোপের অভিযোগ আনে- বেরিয়ে পড়ে একটি গোপন লাল ডায়েরি ও পেন ড্রাইভ উধাও হওয়ার রহস্য। কিন্তু রাজীব কুমারকে জেরা করার জন্য সিবিআই’র উপর্যুপরি অনুরোধেও তিনি সাড়া দেননি, বরং বারবার এড়িয়ে গেছেন তাদের তলব। সিবিআই’র বক্তব্য, সে কারণেই তারা বাধ্য হয়েছিল সটান পুলিশ কমিশনারের বাংলোতে হাজির হতে। তবে এরপর কলকাতা পুলিশ তাদের ‘বস’কে রক্ষা করতে যেটা করে, তা স্বাধীন ভারতে আর কোনো দিন কোথাও হয়েছে কিনা সন্দেহ। তারা ওই সিবিআই কর্তাদের বাংলোতে ঢুকতে তো দেয়ইনি, টেনেহিঁচড়ে তাদের পুলিশের গাড়িতে তুলে কাছের থানাতেও নিয়ে যায়। ঘণ্টা দুয়েক আটক থাকার পরে সিবিআই অফিসাররা থানা থেকে বেরোতে পারেন। ভারতে একটা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব রাজ্য সরকার বা তাদের পুলিশের। কিন্তু সেই যুক্তিতে সেই ‘দারোগা’রা যেভাবে কেন্দ্রের সিবিআই-বেশী ‘কোতোয়াল’দের পর্যন্ত পাকড়াও করে নিয়ে গেছে, দিল্লিতে ভারত সরকারের নেতা-মন্ত্রী-আমলাদের এখনও তা বিশ্বাস করতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে। তখনই অনুমান করা গিয়েছিল, এই সংকট আরও বড় আকার নেবে- আর ঠিক হয়েছেও তা-ই। সূত্র: বিবিসি, এনডিটিভি।