তীব্র ৩০ : মুজিব মেহদীর বাছাই কবিতা

মুজিব মেহদী নব্বইয়ের দশকের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি। গদ্যশিল্পী হিশেবেও তিনি সিদ্ধহস্ত। মৌলিক রচনার পাশাপাশি বিশেষ আগ্রহ তার অনুবাদে। মূলত ছোটকাগজেরই লেখক তিনি। এড়িয়ে চলেন দৈনিকের সাহিত্যপাতা।

পরস্পরের আহ্বানে ‘তীব্র ৩০’ সিরিজে অংশগ্রহণের জন্য কবিকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আসুন পাঠক, এবার প্রবেশ করা যাক তার কবিতায়ৃ

ধূলি ওড়ানোর ভঙ্গি [২০১৮] থেকে
সমুদ্রলেখা

হঠাৎই মনে হলো গর্জনশীলা সমুদ্র লিখি
লোনাজল ছিটকে পড়ুক খাতায়
হিং¯্র বাতাস এসে তুলে নিয়ে যাক আজ মেটেরঙা হ্যাট
মাঝ জলে
যেখানের লাল চোখ ও আগ্রাসী ঢেউ দেখে তমার শরীরভরা
কামনারে মনে পড়ে
কাঁপা কাঁপা সমুদ্র ফড়িং যেন তমার চুলের কাঁটা
উড়ে এসে বসে যাক কবিতায়
ডিপ্রেশনভরা এই সৈকত পৃষ্ঠায়
ঝিমোতে থাকুক দলে লাল কাঁকড়ারা

সাঁতার

সাঁতার শেখো নি বলে ভর্ৎসনা কখনো করি নি
জানি নদীই দেখে নি এক জীবনেÑএমন
ভূরিভূরি লোক আছে
এই নদীমাতৃক দেশেও
স্বপ্নে তোমাকে যেদিন সাঁতার শেখাচ্ছিলাম
বিছানায় বয়ে গেছে জলের প্রবাহÑনদী
ধরে ধরে ব্রেস্ট স্ট্রোক ব্যাক স্ট্রোক
সযতনে দিয়েছি শিখিয়ে
তোমার হাত পা নাড়ানো চাড়ানো দেখে
ঘন ঘন শ্বাসাঘাত শুনে
মনে হয়েছিল তুমি
এ যাত্রা সাঁতার শিখে গেছে
দিব্যি

নশ্বরতা

নিভে আসছে শরীর
বুঝি ফুরাল জ¦ালানি
নতুন ওএস দিলে হতো
কিন্তু পোর্ট নেই
সন্ধ্যাপাখিরা ডাকছে

ভাড়াটে

নতুন ভাড়াটে এল পাশের বাড়িতে
মালামাল সব উঠছে ওপরে
ট্রাকভর্তি অনেক প্যাকেট
আসবাবের সাথে একটা বিষাদ উঠছে
হাঁড়িপাতিলের সাথে একটা কান্না
পালঙ্কের সাথে একটা দীর্ঘশ্বাস
ওয়ার্ডরোবের সাথে একটা অভিমান
পোশাকের সাথে একটা অপমানবোধ
মাত্র তিন রুমের ফ্ল্যাট
এত সব জিনিস কি আঁটবে ওখানে

হাওয়াচিকিৎসা

জীবনটা মেরামত করি ফুরফুরে সবুজ বাতাসে
যেসব স্থানে এর ফুটো হয়ে গিয়েছিল, চাল গলে পানি পড়ত বৃষ্টির, বাতাসের পুডিং লেগে আশা করি তা এখন বন্ধ হবে
বিপুল পরিমাণ অক্ষমতা নিয়ে আমি যে নাস্তানাবুদ প্রায়, হাওয়াচিকিৎসায় তার কিয়দংশ উপশম হলেও হতে পারে
এই যে কেউ ভুল বুঝলে তার ভুল ভাঙানোর কোনো আগ্রহ পাই না, কেউ চেপে ধরলে তাকে ‘না’ বলতে পারি না, এসব অক্ষমতার ঘরেও নিশ্চয়ই এই চিকিৎসার কিছু সুফল বর্তাবে
হাওয়াচিকিৎসার ইনভয়েস আমি ফরোয়ার্ড করে দেবো আমাদের শত্রু বরাবরে
বাইকুশতক [২০১৮] থেকে
বহু মানুষের ছোঁয়াস্পর্ধী এই খোলা বেঞ্চ
গোটা একটা মহাকাব্য চূর্ণ হয়ে লেগে আছে তার গায়ে
পার্কের বেঞ্চিরা বহুভাষাবিদ
সৌন্দর্য একটা ধারণা
কুৎসিতের সৌন্দর্য নেই এটা অপ্রমাণিত
কাঠবিড়ালি ও এমুপাখির সৌন্দর্যচিন্তা আলাদা
টিকটিকি ও গুঁড়িপোকা দেয়ালে একই বাল্বের নিচে
খাদ্য-খাদক দুটোরই ব্যবস্থা করেছে প্রকৃতি
আলো হলো এ দুয়ের মধ্যস্থতাকারী
জীবনটা এক চিরহরিৎ নরক
খোলা জানালা উপচে ওঠে তার
কামিনী ফুলের গন্ধ
সত্যের দুয়ারে পৌঁছুবার দুটোমাত্র ঋতপথ :
সমগ্রকে একসাথে দেখবার অনাসক্ত ভঙ্গি আর
সবটা ছাড়িয়ে অসীম উদার ক্ষমা
জঙ্গলের নিজস্ব শব্দাবলি [২০১৪] থেকে

একুশ শতকের বাংলা কবিতা

দেখতে দেখতে বাংলা কবিতা এমন এক বন্দরের দিকে চলে যাচ্ছে যেখানে মানুষ নেই, মাছরাঙাপাখি ঠোঁট দিয়ে উঠাচ্ছে-নামাচ্ছে সব হীরার জাহাজ
হাঁটুজল কত জল সে বিদ্যা লুফে নিতে নখ দিয়ে জল ফুটো করছে যে গাঙচিল, সে এখন মেয়রের মতো দেখে-শুনে রাখে ওই সমুদ্রনগর, জলগণিকারা প্রতি সন্ধ্যায় ঢেউ তোলে পাখিসমাগমে, পালকের মুদ্রায় শরীর তাতিয়ে পরে বিদেশি মদের দাহে মাতাল বিভোর হয়ে পড়ে থাকে চাঁদরাত
ওখানে নাকি জলের ওপরে বড়ো গাছ হয়, বুদ্ধি সব গাছে ধরে, মাড়াই ঋতুতে জাহাজি চালানে যায় প্রবাসী কবিদের দপ্তরে দপ্তরে সব ঋতুফল
জানি না এলে তাইফুন ওখানের বাসিন্দারা কোনখানে খুঁজে পাবে এত এত শেলটার হোম

জর্নাল

একটা একরৈখিক শ্যামাঙ্গী তীরের গন্ধ মুখস্থ করে ঘোড়দৌড়ের মাঠে গজা লতাগুল্মের যৌনকাতরতা বিষয়ে লেখা জর্নালে মজে আমি লাভলেন পেরিয়ে অ্যানার্কিজমের অন্তরাত্মা ফুঁড়ে ফসল তুলেছি ঘরে
আমার এই মাড়াইমেশিনটিকে কিনে নিতে খ্রিস্টপূর্ব যুগের এক খামারি এসেছে প্রাসাদমূল্য নিয়ে, তার না-কাটা নখের ভয়ে আমি লাঙলের পাশে বসে আত্মরক্ষা করি, এ কাহিনি খতিয়ে না-দেখলে জয়ত্রী ও জায়ফল কী করে এত দামি মসলা হলো তা অজানাই থেকে যাবে
আমি যে মসৃণ বিলাপগুলো একাকী পকেটে নিয়ে ঘুরে আসি শ্যামাগীত থেকে, সে কথা ভোলার আগে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা নিষিদ্ধ আমার, কেননা জবাফুলের গন্ধে মাতালপ্রায় অভিনয়কারীদের বিষয়ে বিরল কোনো প্রতীক রচনায় আমি ব্যর্থ হয়েছি, এই কথা জানিয়েছে রাত্রি চিবিয়ে খাওয়া ঘোরভাসা শ্মশানপুরুষ
সকালে যেসব কান্না খোঁয়াড়ের দরজা কাঁপায়, সেসব হাঁসের বাচ্চাকে আমি ফড়িং ওড়ার শব্দে পারি ভুলে যেতে, তবু ভাঙারি এক মেয়ে আমাকে বাতিল কাগজ ভেবে কুড়িয়ে নিয়েছে
ভাগ্যিস, শালিক পাখি চিনত আমাকে

উচ্চাঙ্গ শিশির

ভিজে যাচ্ছি উচ্চাঙ্গ শিশিরে, সরোদে-সেতারে
স্নানাশায় ভেসে আসি সুরের খেয়ায় আজ শুদ্ধ সরোবরে, ছায়ানটে-ইমনকল্যাণে-পুরিয়ায়
পুরিয়ায় পঞ্চম লাগালে হয় পুরিয়াকল্যাণ, তাতে ভেসে সমস্বরে ঘুরে আসি সোহিনীতে, ছোটো খেয়ালের ছলে হংসধ্বনিতে
আজ দেখি নিজে আমি সুরভরা বাঁশি হয়ে গেছি এক গ-ুলা বাঁশের, পারো তো এবার তুমি আমাকে বাজাও এই প্রকাশ্য সভায়

ছুটি

ছুটির সড়ক বেয়ে যতদূর চোখ যায়
ততদূর বেজিময় শটিগড়
পেখম ছড়িয়ে থাকা রহস্যময়ূর
গোপাট ছাড়িয়ে এক ছমছমে মঠ
সান্ধ্যঘণ্টা শুনে
স্তব করে তিনটে পাথর
জলমহালের ধারে
একা এক বিরহী তিতির
বসে আছে তোমারই পথ চেয়ে
যাবে

ফ্রোজেন প্লানেট

ডগ স্লেজ থেকে নেমে আলাস্কা লাফাচ্ছে
দূরে কোথাও সিল খুঁজছে মেরুভাল্লুক
ভেসে উঠছে বরফ ফাটলে তিমিমাছের পিঠ
শাবকের জন্ম দিতে
কোটপরা ভদ্রলোকেরা বসন্তে যাত্রা করেছে স্থলের দিকে
পথে ডিনামাইটের শব্দে ফেটে যাচ্ছে বরফাস্তরণ
গ্রিনল্যান্ড থেকে ধেয়ে আসছে বিশাল হিমবাহ
তোমাদের ডুবোতরী, তাহাদের তেলকূপ
আমাদের সম্ভাবিত সলিলসমাধি
বুকের ওপর সাড়ে সাত কোটি টন বরফ আমার
ক্রমে গলে যাচ্ছে

ত্রিভুজাসম্ভাষ [২০১৩] থেকে
হাইকুপ্রহর

বৃষ্টিবারি
মেঘের অনুবাদ
জলভাষায়
চৈত্রমাস
জুমঘরে বাতাস
রান্না হচ্ছে
মাতাল চাঁদ
নিশার দারোয়ান
দাঁতাল শীত
টেনে দিচ্ছে
কুয়াশার মশারি
সন্ধ্যারানি
সূর্যমুখী
কোন ঋতুতে ফোটে
আকাশ জানে

বাইকু বর্ণমালা

গ.
গাঁয়ের ভাষা
ছোট্ট গিরির পাশে
বইছে বেগে

ছ.
ছবিবিহীন
বাগবিস্তাররাজি
কষ্টপয়ার

জ.
জয় করেছে
যোনির কূটনীতি
কামদুনিয়া

ঢ়.
আষাঢ় শেষ
বাতাস খেলারত
তালপাতায়


বাংলা ভাষা
শস্যবহুল মাঠ
বিচিত্র সুর

বাইকুসহায়

ভাব = লিঙ্গ
ছন্দ = কনডম
বয়ান = যোনি
আজকের সন্ধ্যার আকাশে
আগামীকালের সকাল দেখছে
একা তালগাছ
খয়েরি ফড়িং
স্থিরজলে দেখছে নিজের ছায়া
দূরে একটা বিমান
বাগানে ভর্তি হলাম পাখিদের ক্লাসে
শিখছি পাতা কাঁপানো ও ফুল ফোটানো
এখনো অনেক দূরে পাতাঝরা দিন
বাশোর ব্যাং সাঁতার দিল
লম্বা ঢেউ জাগল পুকুরে
শতখ-ে সূর্য ভেঙে গেল

সেনরুবিতান

শরীরময়
চিরহরিৎ বন
উদ্ভাসিত
এগিয়ে চলে
কবির ক্যারাভান
শব্দপথে
বন্ধ্যাকাল
শুকিয়ে গেছে নদী
বাকবিভূতি
মাটির দেহ
লাভা উদ্গীরণ
ঋতু¯্রাব
একটা ভাষা
হারিয়ে ফেলি রোজ
জীবনদাহে
চিরপুষ্প একাকী ফুটেছে [২০০৯] থেকে

মন খুলবার শব্দ

মন খুলবার শব্দ পেলাম নরম এই কুয়াশা শরতে, ভেজা ঘাসমাঠ হাহা হিহি করে জানিয়ে গেল রোদের কাছে এই কা-কীর্তি, বিপ্লবী ঘটনা যেন পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বে
কথার শক্তি বিষয়ে আমার ধারণা জন্মেছিল বেশ বালক বয়সে, কথাদের কলা হয়ে উঠতে যে অস্ত্রশস্ত্র লাগে, লাগে যে শানবিদ্যা, বাতাসের চেয়েও ওটা কম আয়ত্তে ছিল, এমনকি জানতাম না যে আয়রনি কাকে বলে, ঘৃণাকে ঘৃণার অধিক কিছু কখনো ভাবি নি
বহু তিতিক্ষা তরণি বেয়ে মতিফুল ফুটল এবার, রূপকাহিনির ভিড়ে ঢাকের বাদ্যের নিচে প্রকাশ্য শব্দ পেলাম মন খুলবার, সাক্ষী হয়ে মাথা নাড়ল শস্যসুরভি

প্রকৃতিপাঠ

স্কুল খুললেও বই কাঁধে আমি যাই নি এ বেলা ক্লাসে
বারান্দায় মোড়া পেতে বসে বসে আকাশ দেখছি
আকাশকে শূন্যতাসুদ্ধ আমার ভালো শিক্ষক বলে মনে হয়
যুগ যুগ একই শিক্ষা নির্গত হয় ক্লাসের ভেতরে
রাতেদিনে গুরুর বাঁশি বাজায় একই সুর
আমি নাদান না-ক্লাস ছাত্র আকাশের আয়নায়
নতুন করে শিখছি প্রকৃতির মনোভাব
মানুষে মানুষে ব্যবধান আসলে বিস্তর
পুরোটা ঘোচানো যার নিরেট কল্পনা

একাগাছ

শালজঙ্গলের কোনো জেরক্স হয় না
পোড়োবাড়ির কোনো সারাই হয় না
আমাকে আধলে রেখে উড়ে গেলে তুমি
পোড়োবাড়ির ধারণা পড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
বাতাসে বাতাসে ভাঙনের সুর বেজে ওঠে
মাঠের ভিতরে থাকা একাগাছ যত দেখি
শূন্যতার তত বেশি পড়ে যাই প্রেমে
গোড়ার জল কী দারুণ আগলে রাখে
থমথমে কালো ছায়া
একদিন সবকিছু ছেড়েছুড়ে
ধুধুপথে হাঁটা দেবো শূন্য অভিলাষে
তুমি জেনে রেখো

এইসব নিয়ে থাকি

বলি লোহালিয়া অতিরূপকথা, তোমার প্যাঁচের ভিতরে সমাজ ও সংসার যেভাবে তরতর বেড়ে ওঠে বাঁচার নিয়মে, আমাকে সেভাবে তুমি রাখো, গাছের আদরে রাখো পাখি
দূরপ্রবাসের তীরে ফণা ধরা হাহাকার ছুড়ে ফেলি, ঢুকি মনের খোড়লে, ওখানে থাকেন যিনি, ভাব করি তার সাথে, তারে ছুঁয়ে যাই, ছুঁতে ছুঁতে যাই, দেখি ঢেউ নাচে হিয়ার বাতাসে আর নাচের মুদ্রার সাথে মেশে এসে জলের গলাও
ধানে-জলে মাখামাখি ভাটিজনপদে, হেসে ওঠে বাংলার দেহবল্লরি, এই রূপকাহিনির দেশে ভেসে যায় রাশি রাশি তরী সদা’গরি, উজানি বাতাসে ভেজা রয়ানির সুর ধেয়ে আসে, বিষণœ বাদামি
ঘুরি পথে পথে আর পথের পাথর বুকে এইসব নিয়ে থাকি, তা না হলে কার সাথে ভাগ করে নেব বলো কুড়ানো বেদনা, এতসব যন্ত্রণাকুসুম

ময়দানের হাওয়া [২০০৬] থেকে
সমুদ্রে

এই মাটি, ঢেউয়ে ঢেউয়ে সমুদ্র দিয়েছেÑটোলঘর, ঝাউবীথি ও কোকের পাহাড়ে বিলি কেটে আজ তার সমূহে নেমেছি, ভেজা ও চলনক্ষম বালিতে বালিতে, দূর সব দিগন্ত-আমোদী রচনায়, নিখিল সংগীতে
সমুদ্রজলের গর্জন আসলে এক নীরবতা, মনে এসে মিশে গূঢ় মন, দূরের জাহাজ, দেহে খসে আরদেহ রতি, উড়ন্ত চিলের পালক
ফেনাময় সমুদ্রপাড়ায় কোনো বিয়ারের ক্যান খোলা হলে, প্রথম সাপোর্ট আসে সমুদ্র থেকেই, জলের বর্তিত গতি মনে হয় বয়ে চলে লোকহিতব্রতে

২.
বিদেশ-বিভুঁ’য়ে এই লাভ হলোÑগর্জনশীলা এক সমুদ্র পেয়েছি বুকে, তার ওপরে হাওয়া, অফুরান শীৎকার
আদি পৃথিবীর স্যুভেনির বয়ে আনে এই বিশালতা, কুড়িয়ে-বাড়িয়ে সেসব জমা করে রেখে দিই বিশাল তোমার নামে, বিশালের নামে নিবেদিত এইসব ভালো, এই মন্দ, সূর্য সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢেউয়ে ঢেউয়ে বহুকাল নৃত্য করে যাবে

৩.
বিশালতা কাকে বলে বুঝেছি সমুদ্রে নেমে, পৃথিবীর তিনভাগ জল মানে কত বারি বুঝেছি সেটাও, তবুও সাহস করি অনুভবে অতল ছোঁবার
দূরত্ব আসলে খুব কম তোমার সাথে আমার, মাঝখানে বয়ে গেছে ছোট নাফ নদী, অভিমান মোটে এই একটিই
বিশালতা বুঝি বলে বড়োর ছোটত্ব বুঝি, ফাঁকি বুঝি, ভেতরে যে মন থাকে, সেও-তো তিনভাগের চেয়ে বেশি জায়গা জুড়ে আমার, কখনো তুমি তা জেনেছিলে
আমি তো পাখির বড়োত্ব মেপেছি চিরকাল, আকাশের বাটখারা দিয়ে

বিড়ালটি

তোমরা চলে যাচ্ছ, ট্রাকে মালামাল উঠে গেছে সব, এক জীবনে মানুষের কতবার যে বাড়িবদল জরুরি হতে পারে মানুষও বুঝি তা জানে না
একদিন এভাবেই ট্রাকে মাল বোঝাই করে রেলিংঘেরা এই বাড়ির নিচতলায় তোমরা নোঙর ফেলেছিলে, অতিথি পাখি ও গৃহস্থ বিড়াল একদিন ভোরবেলা চার সদস্যের একটি নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার দেখে আহ্লাদে উল্লাস করেছিল
তোমরা ত্যাগ করে যাচ্ছ একটি অভ্যস্ত পরিম-ল, তার বিয়োগব্যথায় তুমি কাঁদলে, তোমার মা কাঁদল, ট্রাকের সিটে গিয়ে বসলে সবাই, তুমি, তোমার মা, ছোট ভাই, কুমারী আত্মীয়া
বাবাকে তো আগেই রেখে এসেছ অনিবার্য মাটির বিছানে
গাড়ি স্টার্ট নিতেই তাড়াতাড়ি হাত নাড়লে তোমরা সবাই, শেষবার তাকালে, বাড়িওয়ালা অনুভূতিহীন, তখনি টাঙিয়ে দিচ্ছেন ভাড়াটে ধরার ‘টু লেট’ বাহানা, ঘরে জল ঢেলে ধুয়েমুছে দেয়া হচ্ছে তোমাদের সুদীর্ঘ ছোঁয়া
সব মায়া কাটিয়ে বাধ্য হয়ে তোমরা শহরান্তরে যাচ্ছ, পেছনে কাজলা বিড়ালটি দৌড়াচ্ছেৃ দৌড়াচ্ছেৃ দৌৃড়াৃচ্ছে

হাওয়া

শুকনো পাতায় পাতায় প্রণয় লিখে ছেড়ে দিই হাওয়ার উজান থেকে তোমার দিকে, হাওয়া যদি প্রণয় বোঝে থাকে আর যদি সৎ হয় আর যদি পরস্ত্রীলোভী না-হয়, ঠিক তোমাদের উঠোনে নিয়ে ফেলবে পাতাগুলো
আর তুমিও যেমন, পাতাগুলো কুড়িয়ে পাবেই, এমনকি সন্দেহ করি, লালপায়ে নীলখাম বেঁধে আরদিন কবুতর উড়ায়ে দেবে ফেরত ডাকে

দূরাধিক স্বপ্নকুয়াশাজাল

প্রায়াথর্ব শুয়ে আছি হাজার বছর তমোঘন রাতে, ধ্বনিত সৃজনোল্লাস জীবের শ্রোণিতে, সময় নিকটে এসে ভেঙে পড়ে জলীয় কণার মতো একা, তবু চোখের উপর দিয়ে ধীরে ধীরে একখানি বেড়ে ওঠা ক্রমবর্ধমান, চেরাপুঞ্জির জঙ্গলে বাড়ে যেন জলোল্লাসী গাছ, পাখার ব্যঞ্জনাঘন এই সেই দূরাধিক চাওয়া, সৈকতে বালির প্রায় স্বচ্ছ অভিপ্রায়
সংসার বিষণœগাথা শ্রেয়োজল মাখা, কুসুমিত ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ যৌথ-অধিষ্ঠান, একটা একটা করে ভেতর-ইষ্টক খসে খসে অলংকৃত ফাটলে ফাটলে যেন পোড়োবাড়ি, ভেঙেচুরে দিনে দিনে ইতিহাস লিখে চলে বয়সের বলিরেখাজুড়ে, তার সিক্ত ক্ষতদেহে উদ্গত অঙ্কুর এক মহীরুহ প্রায়, আড়েদিঘে বেড়ে ওঠে নিতিদিন
নিচে তার প্রায়ান্ধ সাদা ঘাস, আলো সন্ধানে প্রস্থাপ্রস্থি কেবলি লম্বা হতে থাকি

বক্ষগ্রহপুঞ্জে

এইসব পাথরপ্রবর আমি রাখব কোথায়, পরিসর ছোট হয়ে যদি আসে দিন দিন নিখিল বুকের, এইসব ক্ষতের বেদনা আমি ঘুচাব কেমনে, পাঁজরবাঁশিতে যদি বেজে চলে নিত্য হাহারব
নবীনা ইচ্ছেরা যেন ডুবিগাঁও, ভাসাÑতার মেঠোপথ, উতলা বনের শিস, চতুষ্পাঠী বেলা
বক্ষগ্রহপুঞ্জে ক্রমে জাগিতেছে যতিবন, অবদমনের ঢের জলা
মমি উপত্যকা [২০০১] থেকে

কয়লাতামস

এত যদি সুখসন্ধিৎসা
মোহের বিস্তার
ধরো
তমসার তীর ধরে যেতে যেতে একদিন
এ শরীর প্রাপ্ত হলো কয়লাখনির রূপ
শরীর যেহেতু তাকে প্রাণময় ভাবো
অপ্রাণেও যেরকম প্রাণ থাকে জড়ধর্মের
হাজারো শ্রাবণ গেল তারপর একে একে
শরীর-পরিধিজুড়ে জমা হলো চাপ চাপ স্বর্ণরেণু
সম্ভবতার অধিক গাঢ় কুঞ্জলিপ্ত রোদ
ঘুমন্ত ও লুকানো সে বিলাসধাতুর মোহে
তখনো কি ভাসবে না কয়লাতামসে
তবু

আত্মপাঠ

সে তাকাতে কহিয়াছে আমি তাকায়েছি যাহা দৃষ্টিপাপ বটে
কেননা ইহা অতি উত্তম
সে বলিতে কহিয়াছে আমি বলিয়াছি যাহা সদাসত্য বটে
কেননা ইহা অতি উত্তম
সব মোহ তুমি ত্যাগ করিয়াছ জলে ছুড়িয়া দিয়াছ চাবি
বাসি প্রচলেরÑসে কহিল
সব লোকলাজ তুমি ভুলিয়াছ মুখে তুলিয়া দিয়াছ তালা
যত নিন্দুকেরÑসে কহিল
কেননা ইহা অতি উত্তম
কেননা ইহা অতি উত্তম
তাহারে তো দেখি নাই নিরাকার নৈঃশব্দ্যম-িত কহে কথা
কেননা ইহা সত্য স্বরূপা
তাহারে তো দেখি নাই আজনম বুকের গহিনে গূঢ় ব্যথা
কেননা ইহা সত্য স্বরূপা
আমার ভেতরে থাকে আমি কেননা ইহা উত্তম অভিরুচি
মরিতে বলিলে সে মরে যাই বাঁচিতে বলিলে সে তবে বাঁচি

রূপকথা

স্বপ্ন তাকে শুভেচ্ছা দিয়েছিল তিমিরাকুল গিরিগুহা আর কাকতন্দ্রা থেকে জেগে গাঙুড়ের জলে মুখ ধুয়ে সে ঘোষণা করেছিল অজন্তা-ইলোরাৃ আক্রমণের জবাবে তাকে বারবার পালটাতে হচ্ছিল ছেঁড়া তার, মুখে ফেরা সুরসংকটের চাপা ক্ষোভ, শিল্পহীনতার অভিযোগ
হেরপর কল্লো না তো কল্লো কী
জল এল বরফকুচি পাতিলেবুৃ সরাবিক প্রতিদিন ঘোরের অতল তলে জগৎ সৃজিল, দেয়ালে দেয়ালে যত গুহাচিত্রের নাম গেল সেঁটে, আর ছেঁড়া তার বাঁধতে বাঁধতে মনে দেখল সে, মাল্যহস্তে দুয়ারে দাঁড়ায়ে আছে শিল্পের দেবী
হেরপর
চোখের পাতায় জেগে থাকল অনিদ্রাপরি, ঘুমমত্ত ছায়াসাথী নিশিরঞ্জনা, শ্বেতী জোছনায় লাগাতার হইহুল্লোড় আর হাঁটুর ভাঁজে ভাঁজে মৃত্যুকে সহবাসী করে আয়াসে জীবনপাতী লিখনপ্রক্রিয়া
হেরওপর
ঝাঁক ঝাঁক সারসীর ধলা পাখা দুলে উঠল আকাশের নীলায়, পৃথিবী তাকাল তার দিকে, আর ঘাসস্থান খুঁজে নিয়ে ধীরেসুস্থে শুলে সে, তার শোকে পঞ্চনিশি রোদন করল বৃক্ষ এবং পাখি

অগ্রন্থিত কবিতা
ভার্চুয়াল

ভাসে শুধু
ডোবে না মোটেই
আঙুল ভেজে না
শুধু রিহের্সাল
মহড়া মহড়া খেলা
ফাইনাল কখনো জমে না
ছোঁয়া নেই ধরা নেই
গভীর সঙ্গম

যে কোনো অজ¯্রতা

যে কোনো অজ¯্রতা
বিষয়ের গুরুত্ব কমায়
প্রতিটা পাতাঝরা তাৎপর্যপূর্ণ
অথচ আলাদাভাবে সবাইকে ভাবা
এপিটাফ লেখা
কেঁদে ওঠা
মানুষ পারে না
কারো মৃত্যুতে কেউ না কাঁদলেও
সে মৃত্যুও মৃত্যু
পথমাত্র পথিকের প্রতি নিবেদিত
তার শয়ন আনুভূমিক হোক বা উলম্ব
যে কোনো অজ¯্রতা
আমাদের বিকল্প দেখায়

পাখিসম্প্রীতি

পাখিঅভিধানে কোনো ধর্মসংস্কার নেই
শালিকের কামকেলীতে কখনো আহত হয় না
কাকের ধর্মীয় অনুভূতি
পাখিকুলে সন্ধ্যারতি নেই
হিজাব-টিজাব নিয়ে নেই মাথাব্যথা
পাখিসমাজে চাপাতি ব্যবসা জমে না
সহ¯্র প্রজন্ম গেল পাখিদের
কখনো বাঁধে নি কোনো গুরুতর দাঙ্গা
পাখিপাড়ায় কাজেই কারো মহাত্মা গান্ধী হবার সুযোগ নেই

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!