রোহিঙ্গারা নাগরিক কিনা, জানেন না সু চি!
ডেস্ক: এক সময় দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতীক সু চি রোহিঙ্গা নিপীড়ন প্রশ্নে নিজের অবস্থানের কারণে বিশ্বব্যাপী আস্থা হারিয়েছেন এরইমধ্যে। রয়টার্স প্রকাশিত এক বিশেষ প্রতিবেদনে সু চির রাজনৈতিক উত্থান ও পতনের ঐতিহাসিক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১২ সালে সামরিক জান্তাদের অংশীদার হয়ে অনির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি পার্লামেন্টে আসার বছরেই প্রশ্নবিদ্ধ হয় তার ভূমিকা। সে সময় রোহিঙ্গা নিপীড়ন প্রশ্নে কার্যত নীরব ভূমিকা পালন করেন সু চি। এক বছর পর নরওয়েতে সাংবাদিকরা তার কাছে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে সু চি উত্তর দেন, তিনি জানেন না।
২০১২ সালে মিয়ানমারের উপনির্বাচনে সু চির অংশগ্রহণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা।আশঙ্কা ছিল, নির্বাচনে অংশগ্রহণের কারণে সামরিকতন্ত্র রাজনৈতিক বৈধতা পাবে, তা সত্ত্বেও তিনি। তা সত্ত্বেও তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) নির্বাচনে অংশ নেয়। প্রচার চালানোর সময় জনগণের কাছ থেকে বিপুল সমাদর পেয়েছিলেন সু চি। উপনির্বাচনে তার দল এনএলডি ৪৪ আসনের মধ্যে ৪৩টি আসনে জয়লাভ করে।
২০১২ সালের মে মাসে অনির্বাচিত সংসদ সদস্যদ হিসেবে সংসদে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সংসদে যোগ দেন সু চি। মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী দেশটির মোট আসনের এক চতুর্থাংশ বরাদ্দ সেনা কর্মকর্তাদের জন্য। সেনাবাহিনীর হাতেই ক্ষমতা থাকে সেনাবাহিনী ও পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করার। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেভিন রুড মনে করেন, সু চি রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটির ভেতরে ঢুকে তার পরিবর্তন ঘটাতে চেয়েছিলেন। ‘তার পরিকল্পনা ছিল সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করা এবং দেখা, বদলে কতটা প্রত্যাশা পূরণ হয়।
তবে সু চির প্রতি যে শ্রদ্ধা ছিল মিয়ানমার ও বিশ্বের ওয়াকিবহাল মহলের তাতে আঘাত আসে ২০১২ সালের জুন মাসে। সে সময় রাখাইনে বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারায় প্রায় ৮০ জন। হাজার হাজার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গারা বর্ণ্যবৈষম্যের মতো পরিস্থিতির শিকার হচ্ছিল। পশ্চিম মিয়ানমারের বসবাসকারী এই জনগোষ্ঠীর মানুষদের যেমন স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ ছিল না, তেমনি ছিল না শিক্ষাসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা। ২০১২ সালেই জাতিসংঘ জানায়, অত্যাচার ও দারিদ্র্য থেকে বাঁচতে দুই লাখ ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
১৩ জুনে রাখাইনে সহিংসতার আগুন তখনও জ¦লছিল। এমন অবস্থায় সু চি ইউরোপের পাঁচ দেশ সফরে বের হন। লন্ডনে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে দেখা করেন। নরওয়েতে সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেন, রোহিঙ্গারা কি আপনার দেশের নাগরিক নয়?’ সু চি উত্তর দেন, ‘আমি জানি না।’ ২০১২ সালের অক্টোবরেই আবার রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা চালানো হয়। এবার হামলার মাত্রা হয় আগেরবারের চেয়েও অনেক বেশি তীব্র। তারপরও সু চি রোহিঙ্গাদের পক্ষে কোনও কথা বলতে রাজি হলেন না। ২০১৩ সালে বিবিসিকে তিনি বিবিসিকে বলেছেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে যদি আমি কোনও পক্ষে কথা বলতাম তাহলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে আরও বেশি সহিংসতার জন্ম নিত। দুই পক্ষই সহিংসতায় জড়িয়েছে।’ বিশ্বজুড়ে এতদিন ধরে সু চির সমর্থনে যারা কাজ করেছেন সু চির এমন কথা শুনে তারা বিস্মিত হয়ে পড়েন।
তাদের মনে প্রশ্ন ঘুরপাক করতে থাকে, ‘কেন নৈতিকতার এমন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ¤্রয়িমাণ হয়ে পড়েছে?’ কয়েক প্রজন্ম ধরে রাখাইনে বসবাস করে এলেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব স্বীকার করে না মিয়ানমার। মিয়ানমারের অধিবাসী হলেও রোহিঙ্গাদেরকে বেশিরভাগ রাখাইন বৌদ্ধ বাংলাদেশ থেকে সেখানে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী বিবেচনা করে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গারা রাখাইনে থাকলেও মিয়ানমার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না।
উগ্র বৌদ্ধবাদকে ব্যবহার করে সেখানকার সেনাবাহিনী ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে স্থাপন করেছে সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের চিহ্ন। বিদ্বেষী প্রচারণার মধ্য দিয়ে রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেখানকার রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ ঘৃণার চাষাবাদ করেছে দীর্ঘদিন।
বিদ্বেষের শেকড় তাই দিনকে দিন আরও শক্ত হয়েছে। ৮২-তে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে পরিচয়হীনতার কাল শুরু হয় রোহিঙ্গাদের। এরপর কখনও মলিন হয়ে যাওয়া কোনও নিবন্ধনপত্র, কখনও নীলচে সবুজ রঙের রশিদ, কখনও ভোটার স্বীকৃতির হোয়াইট কার্ড, কখনও আবার ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ কিংবা এনভিসি নামের রং-বেরঙের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষকে। ধাপে ধাপে মলিন হয়েছে তাদের পরিচয়।
ক্রমশ তাদের রূপান্তরিত করা হয়েছে রাষ্ট্রহীন বেনাগরিকে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সাম্প্রতিক অনুসন্ধান অনুযায়ী, সেনা নিধনযজ্ঞের শিকার হয়ে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর বৌদ্ধ পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে রাখাইনকে রোহিঙ্গা শূন্য করা হচ্ছে।