শীতে নাস্তানাবুদ উত্তরের জনপদ
নিজস্ব প্রতিবেদক : হাড়কাঁপানো শীত, কনকনে ঠান্ডা বাতাস ও বৃষ্টির মতো নেমে আসা কুয়াশায় নাস্তানাবুদ পাবনাসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো। কয়েক দিন ধরে সূর্যের দেখা না মেলায় শীত যেন আরও জেঁকে বসেছে। দিনের বেলা একটু হালকা হলেও বাকি সময় মাঠ-ঘাট ঢেকে থাকছে ঘন কুয়াশায়। রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল ও যানবাহনের সংখ্যা কমে গেছে। বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন খেটে খাওয়া ও ছিন্নমূল মানুষ। আমাদের জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
পাবনা : উত্তরের জেলা পাবনায় প্রচন্ড শীতে কাহিল হয়ে পড়েছে মানুষের পাশাপাশি প্রাণীকুলও। গত রাতে গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে শীতের তীব্রতা বেড়েছে কয়েকগুন। গত কয়েক দিন ধরে দেখা মিলছে না সূর্ষের। মাঝে মধ্যে কিছু সময়ের জন্য সূর্ষের দেখা মিললেও কমছে না শীতের তিব্রতা। স্থানীয় আবহাওয়া অফিস আজ সকালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে ১২ দশমিক ৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
পঞ্চগড়ে : গত কয়েক দিন ধরে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে পঞ্চগড়ে। গতকাল শুক্রবারও দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃহস্পতিবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বৃহস্পতিবার ৯টার পর সূর্যের দেখা মিললেও গতকাল সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত জেলা শহরসহ এর আশপাশ এলাকা কুয়াশায় ঢেকে ছিল। দুপুরের পর সূর্যের মুখ দেখা গেলেও রোদে তেজ নেই। গত এক সপ্তাহ ধরে অব্যাহতভাবে বইছে শৈত্যপ্রবাহ। পাশাপাশি ঘনকুয়াশার চাদরে ছেয়ে গেছে মাঠঘাট প্রান্তর। কনকনে ঠান্ডা বাতাস ও ঘন কুয়াশায় জবুথবু হয়ে পড়েছে এখানকার মানুষ। রাস্তাঘাটে লোকজন চলাচল কম। যানবাহনও চলাচল কমে গেছে। রাত থেকে বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়ছে। রাস্তাঘাট ভিজে গেছে। শীতের তীব্রতায় শহরের মানুষও খড়কুটো জ¦ালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন।
তীব্র কুয়াশা আর শৈত্যপ্রবাহে করে খেটে খাওয়া মানুষ ও রিকশা-ভ্যান চালকরা দুর্ভোগে পড়েছেন। শীতবস্ত্রের অভাবে দুর্ভোগে পড়েছেন গরিব ও ছিন্নমূল মানুষ। শীতার্ত মানুষের জন্য এখন শীতবস্ত্র বিতরণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারিভাবে পঞ্চগড়ে এ পর্যন্ত ৪০ হাজার শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
এর পাশাপাশি গত এক সপ্তাহ ধরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পঞ্চগড় ১৮ ব্যাটালিয়ন, ব্যবসায়ীরাসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তি শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে। পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রহিদুল ইসলাম জানান, গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টায় পঞ্চগড়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এটি দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। গত চার দিন ধরে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে তেঁতুলিয়ায়।
এদিকে শীত ও শীতজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে এখন পর্যন্ত অর্ধশত রোগী ভর্তি হয়েছেন। তবে হাসপাতালে রোগী ভর্তির চেয়ে বহির্বিভাগে শীত ও শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বেশি বলে জানিয়েছেন পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মনোয়ারুল ইসলাম। তিনি আরও জানান, গত ২৪ ঘন্টায় ১১ জন শিশু ভর্তি হয়েছেন। শীতের তীব্রতা বাড়লে ভর্তির সংখ্যাও বাড়তে পারে।
এদিকে তীব্র এই শীতে আলু ও বোরো ধানের চারার ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। কিছুকিছু বোরো চারায় এরইমধ্যে হলুদ হয়ে জ¦লে যাচ্ছে। অবশ্য কিছু কৃষক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বোরো চারার ক্ষেত পলিথিনে ঢেকে দিয়েছেন। বোদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুনুর রশিদ জানান, ঘনকুয়াশা গম ও সরিষার জন্য ভালো হলেও আলু, বোরো ধানের চারার জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু যেহেতু সকালে বা দুপুরের পর সূর্যের উঠছে এ কারণে এবার তেমন ক্ষতির আশঙ্কা নেই।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন জানিয়েছেন, শীতবস্ত্র বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। সরকারিভাবে প্রায় ৪০ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। আরও বরাদ্দ চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
দিনাজপুর : হিমালয়ের কাছাকাছি অবস্থিত দিনাজপুরে বইছে মৃদ্যু শৈত্য প্রবাহ। গতকাল শুক্রবার জেলায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সকাল থেকেই ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন রয়েছে পরিবেশ। সঙ্গে হিমেল বাতাস।
কনকনে ঠান্ডায় নাকাল হয়ে পড়েছে জনজীবন। কৃষক সফিকুল ইসলাম জানান, ‘শীতের কারণে কাজে বের হওয়া যাচ্ছে না। ক্ষেতে নিড়ানি দিতে হবে। কিন্তু ফসলের গাছে লেগে থাকা শীতে গা ভিজে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ঠান্ডা। তাই কাজ না করেই বাড়িতে ফিরতে হচ্ছে।’ ইজিবাইক চালক সমশের উদ্দিন জানান, ‘শীতে হাত পা ব্যাথা করছে। কিন্তু পেটের ভাত জোগাড় করতে হবে। কোনও উপায় নাই। তাই বাধ্য হয়েই কাজে নেমেছি। কিন্তু দুপুর হতে না হতেই বাড়ি ফিরে যেতে মন চাইছে। আর সহ্য করা যাচ্ছে না এই শীত।’
দিনাজপুর আঞ্চলিক আবহাওয়া কার্যালয়ের পর্যবেক্ষক তোফাজ্জল হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার দিনাজপুরের তাপমাত্রা ছিল ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে গতকাল তাপমাত্রা একটু বেড়ে ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হওয়ায় এবং আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় একটু বেশি শীত অনুভুত হচ্ছে। তবে এই জেলায় বৃষ্টিপাতের এখনও কোনও আশঙ্কা নেই।’
নীলফামারী : উত্তরের জেলা নীলফামারীতে এখন বইছে মৃদু শৈত্য প্রবাহ। এতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গতকাল শুক্রবার জেলায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সৈয়দপুর বিমান বন্দর আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. লোকমান হাকিম মৃদু শৈত্য প্রবাহের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
শুক্রবার তা বেড়ে ১০ দশমিক ৫ ডিগ্রি হয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় এই তাপমাত্রা অব্যাহত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উপজেলার খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের খগাখড়িবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা নছির উদ্দিন (৫৭) বলেন, ‘এবার যে ঠান্ডা বাহে, ঘর থাকি বেরাই যায়ছে না। হাত-পাও খালি টাটায়ছে। একখান কম্বল কাহো দিলে শীতখান পার হইল হায়। গতবার চেয়ারম্যান একনা কম্বল দিছিলো, এবার খবরে পাও নাই।’
স্থানীয়দের দাবি, প্রকৃত শীতার্ত মানুষ শীত বস্ত্র থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জেলা সদরের রামনগর ইউনিয়নের বাহালী পাড়া গ্রামের ভ্যানচালক মতিয়ার রহমান (৫৪) বলেন, ‘ঠান্ডায় ভ্যানের হেন্ডল ধরায় যায় না। হাত একেবার অবস।
দুইদিন থাকি বাড়িত বসি আছি, কামাই নাই। খালি আগুন পোয়ে (তাপ) দিন যায়ছে। শীতে হামার জীবন শ্যাষ। বাতাসত বেরায় যায় না। এতে হামার কষ্ট হইছে।’ ডিমলায় পাঁচ হাজার ৬০০ কম্বল বিতরণের কথা নিশ্চিত করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. নাজমুন নাহার।
তিনি বলেন, আরও তিন হাজার কম্বলের চাহিদা পাঠানো হয়েছে। এবার শীতের কনকনে ঠান্ডায় শীতবস্ত্রের চাহিদা বেড়েছে বলে তিনি মনে করেন।
জেলা ত্রান ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা এসএ হায়াত জানান, এ যাবত তিন দফায় ৭৬ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও আরও ২০ হাজার কম্বলের চাহিদা পাঠানো হয়েছে। দ্রুত তা পাওয়া যাবে বলে আশা করেন তিনি।