সদা থাকো আনন্দে—আনোয়ারা আল্পনা
সদা আনন্দে থাকা ব্যাপারটা আসলে কেমন? রবি ঠাকুর তো বলেই খালাশ। সদা আনন্দে কি থাকা যায়? আর শুধু রবি ঠাকুর বললে এত পাত্তাও দিত না দুলাল। রবি ঠাকুর তো ইদানীং বলেন নাই, সদা থাকো আনন্দে, অনেক দিন আগেই বলেছেন। তাহলে এতদিন পরে কেন দুলাল সদা আনন্দে থাকা নিয়ে ভাবতে বসল? কারণ আছে, শুধু শুধু একটা কিছু নিয়ে চিন্তা করার লোক সে নয়।
দুলালের বয়স পঁয়তাল্লিশ হবে এই জুনে। অবিবাহিত, স্বাস্থ্য ভালো, ক্যারিয়ার ভালো। গতকাল রাতে তার দীর্ঘ দিনের প্রেমিকা তাকে বলেছে, ‘অনেক হলো এসব প্রেম-ট্রেম। চল সব শেষ করি।’ এবং সব শেষে বলেছে, ‘সদা আনন্দে থাকো!’
সব শেষ হয়ে যাওয়ার মতো কিছু তাদের মধ্যে হয় নাই যদিও। দুলাল এখনও নাদিয়াকে যথেষ্টই ভালোবাসে। কিন্তু হয়তো নাদিয়ার প্রেম শেষ হয়ে গেছে। দুলাল ভাবে, প্রেম তো এমন কিছু না যে, শেষ হতে পারবে না। এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল, কিন্তু শেষের কথাটাই ঝামেলা পাকালো, মানে সদা আনন্দে থাকো তো আর বলা যায় না, কাছাকাছি একটা কথা বলেছে নাদিয়া, ‘সবসময় ভালো থাকো।’ সব সময় ভালো থাকো, কথাটা গতকাল রাতে মামুলি একটা ফিনিশিং কথাই ছিল। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে এটা দুলালের কাছে হয়ে গেল, সদা থাকো আনন্দে।
সে ভাবল, প্রেমিকা যখন চেয়েছে সদা আনন্দে থাকি, তখন চেষ্টা করে দেখা যাক। নাদিয়াকে প্রেমিকা নাকি সাবেক প্রেমিকা বলবে সেটা নিয়ে একটু চিন্তা করে সে। তারপর ভাবে কেবল একদিন গেছে, এখনই সাবেক বলা ঠিক হবে না। নাদিয়া ফিরে এসে আবার বর্তমান হতেও পারে। সে যাই হোক আপাতত আনন্দে থাকা শুরু করা যাক। সকালবেলার প্রথম সিগারেট ধরিয়ে বাথরুমে গেল সে। অন্যদিন সকাল আটটায় ম্যাসেঞ্জারে, নাদিয়া একটা কোনো গান পাঠিয়ে শুভ সকাল জানায়। গানটা চালিয়ে দিয়ে বাথরুমে ঢোকে সে। আজ গান ছাড়াই চমৎকার বাথরুম হলো। সকালবেলা পেট ভালো করে পরিষ্কার হলে দিনটা আনন্দেই যাবে ভেবে খুশি হলো সে। ফ্ল্যাশ করে পরের কাজটা নিয়েও ভাবল সে। হ্যাঁ দাঁত মাজাও নাইস স্টার্টের অংশ। ব্রাশ করতে গিয়ে পুরান ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে সে ভাবল, নতুন ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজা যাক। পেস্ট লাগানো ব্রাশটা ফেলে দিয়ে নতুন ব্রাশে ফের পেস্ট লাগালো। খুব জোরে জোরে দাঁত মাজে সে। আজ নতুন ব্রাশ অতটা জোরের প্রতিবাদ করল। বেসিনে সাদা ফেনার বদলে গোলাপি ফেনা পড়ল। কল ছেড়ে রক্তওয়ালা থুতু ধুয়ে ফেলার আগে তার মনে হলো, রংটা বদলে দিলে কেমন হয়? ব্রাশ মুখে দিয়েই চমক নীলের বোতলটা খুঁজে এনে সাবধানে এক ফোঁটা নীল ফেলল থুতুতে। সুন্দর একটা রং হলো। দেখে ভালো লাগল তার।
দুলালের মনে পড়ল, একদিন নাদিয়ার ডান হাতটা নিজের গালে ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে একটা আঙুল মুখে পুরে দিয়েছিল সে।
গোসল করতে করতে সে ভাবল, আজ যেহেতু সদা আনন্দে থাকব, তাহলে অফিস কামাই করব? অফিসে ফোন করে বলব, পেট খারাপ? কিন্তু পেট তো খারাপ নয়, চমৎকার নির্গমন হয়েছে। হিসুটা পর্যন্ত অন্যদিনের চেয়ে কম হলুদ ছিল। কিন্তু আনন্দে থাকার অজুহাতে অফিস কামাই করার আইডিয়া পছন্দ হলো না তার। অন্যদিন যা করি, তা-ই করেই আনন্দে থাকব আজ, নিজেকে বলে অফিস যাওয়াই স্থির করে, বেরিয়ে এল গোসল শেষ করে। সকালে সে কলা, আগের রাতে কেনা ব্রেড আর তিতা কফি খায়। ভাবল, সদা আনন্দে থাকা শুরু হয়েছে কিনা, নাস্তা খেতে খেতেই বোঝা যাবে। অন্যদিন নাস্তা খেতে খেতে নাদিয়ার সঙ্গে চ্যাট করে সে। সকালে এই যে শুকনা নাস্তা খাওয়ার অভ্যাস হয়েছে, সেটা হাত ফ্রি রাখার জন্যেই। সকালবেলা নাদিয়ার মুড থাকে পাড়ার মুদি দোকানির মতো। সারাদিন যেন ভালো যায় এটা কবিতার চেয়েও বেশি আছে দোকানির আগরবাতিতে। নাদিয়াও সকালবেলা নাইস স্টার্ট করতে চায়, চুমু বা শরীরের অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আদরের কথা সকাল বেলা বলে না, বেলা যত বাড়ে তৃষ্ণা বাড়ে। আজকের সকালে দুলাল অনেকদিন পরে খবরের কাগজটা ভালো করে পড়ল। আর কফি খেতে খেতে তার মনে হলো, কফির গন্ধটা দারুণ! দুলালের মনে পড়ল, একদিন নাদিয়ার ডান হাতটা নিজের গালে ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে একটা আঙুল মুখে পুরে দিয়েছিল সে। একটু পরে অবাক হয়ে দুলাল বলেছিল, ‘এই নাদিয়া, তুমি কফি হয়ে গেছ!’ সেদিন দুপুরবেলা বিরাট সাইজের একটা চকলেট ভেঙে ভেঙে অফিসের কলিগদের দিয়ে, নিজেও খেয়েছিল এক টুকরা, তারই একটু লেগেছিল নখে। সেই একবারই তাদের দেখা হয়েছে ঢাকায়। আজ সকালে ব্ল্যাক কফিতে নাদিয়ের নখের মতো স্বাদ পেয়ে, সদা আনন্দে থাকা শুরু হয়েছে, বুঝতে পারল দুলাল।
সিলেট উপশহরের এই বাসায় সাড়ে তিন বছর ধরে থাকে দুলাল। তাদের ব্যাঙ্কের যখন সিলেটে ব্রাঞ্চ করার কথা হলো, এমডি তখন তাকেই বেছে নিলেন ম্যানেজার করে পাঠানোর জন্য। তার আগে চিটাগং আর খুলনা ব্রাঞ্চের সময়ও সাব-ম্যানেজার ছিল সে। একটু সিনিয়র হওয়ার পর ঢাকায় হেড অফিস জাঁকিয়ে বসেছিল, ভেবেছিল এইবার ঢাকায় সেটল করবে, লোন নিয়ে ফ্ল্যাট কেনার কথাও ভাবছিল। তখনই সিলেট পাঠানোর কথা হলো। দুলালের সিলেট আসতে আপত্তি ছিল না। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সে। বন্ধুদের কেউ কেউ এখানেই মাস্টার হিসেবে রয়ে গেছে, ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেই, ‘চইলা আয়, ঢাকায় মানুষ থাকে?’ বলে উৎসাহ দিয়েছিল। সিলেটে এসে প্রথম কিছুদিন হোটেলে ছিল সে। এই হোটেলেই নাদিয়াকে প্রথম দেখে, রিসেপসনে। ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছিল ওরা সপরিবারে, বিশাল দলবল। অফিস থেকে ফিরে হোটেলে ঢুকছিল সে, দেখল শীতের সন্ধ্যায় রিসেপ্সনের সামনে অতিথি পাখির কিচিরমিচির। না এসব উপমা দেওয়ার লোক নয় সে, কিন্তু সেদিন কেন যেন অতিথি পাখির কথাই মনে হয়েছিল তার। দলের মধ্যে থেকে কেউ একজন নাদিয়ার নাম ধরে ডেকেছিল। চাবি নিতে নিতে আড় চোখে দেখেছিল সে, ডাক শুনে কে ঘাড় ফেরায়। তারপর চাবি নিয়ে ঢুকে গিয়েছিল লিফটে। ওরা দুই তিনদিন ছিল, আরো দুই একবার দেখা হয়েছে। তারও অনেকদিন পর একদিন হঠাৎ গুগলে নাদিয়া লিখে সার্চ দেয় সে। টিভির এক নায়িকাকে দেখতে দেখতে নিচে নামছিল, হঠাৎ থেমে প্রায় আর্তনাদ করে উঠেছিল দুলাল,‘শি ইজ আ রাইটার!’
ফেসবুকে একটা অ্যাকাউন্ট আছে দুলালের। সেটাতে প্রায় ঢোকাই হয় না। অফিসের কাজে প্রায় আঠারো ঘণ্টা জিমেইলে থাকতে হয়। নাদিয়ার ওয়েব সাইট ঘুরে এসে একটা মেইল করেছিল। সিলেটের হোটেলে এক ঝলক দেখা হওয়ার কথা লিখেছিল।
পরিচয়ের কাহিনি থাক, আপাতত দুলালের আজকের আনন্দযাত্রার সঙ্গী হওয়া যাক। নাদিয়ার নখের স্বাদের কফি খেয়ে সে অফিসের জন্য রেডি হতে শুরু করল। একা থাকে সে, সপ্তাহে একদিন বাসা পরিষ্কার করে, কাপড় ধোয়। কাজের জন্য একটা বুয়া বা অন্তত অফিসের পিয়নের সাহায্য নিতে পারত। কিন্তু তাদের দিয়ে কী কাজ করাবে খুঁজে পায় নাই সে। একজনের খাবার তৈরি করা খুব সহজ কাজ, বাইরেই খেয়ে নেয় বেশির ভাগ। ক্যাম্পাসের মাস্টার বন্ধুদের বাসায় দাওয়াত খায়। মাঝেমধ্যে নিজে রান্না করে, দিব্যি চলে। মাসের শেষ বৃহস্পতিবার নাদিয়া এলে বাসায় ওঠে না কখনও, কোনো একটা রিসোর্টে ওঠে তারা। সিলেটের আশপাশে প্রচুর রিসোর্ট হয়েছে এখন। তিন বছরে ত্রিশবার দেখা হয়েছে তাদের, সবই সিলেটে। মাসের শেষ বৃহস্পতিবার অফিস করে, ঢাকা থেকে রাতের ট্রেনে করে সকালে এসে পৌঁছায় নাদিয়া, স্টেশনে থাকে দুলাল। কোনো একটা রিসোর্টে গিয়ে দুপুর পর্যন্ত ঘুমায় সে। পাক্কা তিন ঘণ্টা ঘুমন্ত নাদিয়ার মুখের দিকে, মৃদু ওঠা-নামা করা বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে দুলাল। নাদিয়ার ঘুম দেখে মনে হয়, মাসে এই তিন ঘণ্টাই ঘুমায় সে। ঘুম দেখতে দেখতে নেশা ধরে যায় দুলালের, তি নঘণ্টা পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে চুমু খায়, চমকে ঘুম ভাঙে নাদিয়ার।
আজও মাসের শেষ বৃহস্পতিবার। আজ নাদিয়া আসবে না, হয়তো আর কোনোদিন আসবে না। দুলাল ভাবে, তাতে আমার আনন্দে থাকা আটকাবে না। সবচেয়ে ভালো শার্টটাই পরল সে।
দারুণ কুল বস হয়ে অফিসে ঢুকল। এমনিতেও বাজে বস নয় সে। ছোট একটা ব্রাঞ্চ, কয়েকজন মাত্র স্টাফ। তবে নতুন ব্রাঞ্চ করার জন্য সিলেট টাফ সিটি বলে সবসময় মাথা ঠান্ডা রাখা যায় না। তার বিশ বছরের ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে ডিপোজিট যোগাড় করার জন্য সবচেয়ে কঠিন লেগেছে সিলেটকে। কিন্তু আজ কিছুতেই সদা আনন্দে থাকা মাটি করবে না সে। আর মানুষ চাইলে কী না হয়, এগারোটা না বাজতেই বিশ লাখ টাকার ডিপোজিট পায়ে হেঁটে এসে হাজির। পান খাওয়া লাল ঠোঁটের ভদ্রলোক, দুলালের সকালটা রঙিন করে দিল, এ মাসের ঘাটতি ডিপোজিট পুরা করে দিল। জামানতকারি বেরিয়ে গেলে, আমানতকারির ফুরফুরে মুড নিয়ে অফিসের সবাইকে লাঞ্চ করালো সে।
যেসব কথা নাদিয়া বলেই ভুলে যায়, সেসব লিখে রাখে দুলাল।
বিকালের দিকে শাহজালাল ক্যাম্পাস থেকে বন্ধু প্রশান্তের ফোন, ‘দোস্ত, রাতে পানাহারের দাওয়াত, বাচ্চারা নাই বাসায়, আইজ ধুম আড্ডা হবে রে, মন খুলে মদ খাব, আইসা পড়িস।’ মন খুলে রেখে কেন মদ খেতে হবে ভেবে পায় না সে। যদিও আজ সে অন্যদিনের মতো করেই আনন্দে থাকতে চেয়েছিল, একা একা, কিন্তু বন্ধুকে বলল, ‘আচ্ছা আসতেছি।’ অফিসের একটা গাড়ি আছে। দুলালের বউ বাচ্চা থাকলে সেটা তারা ব্যবহার করত হয়তো। এখন এটার তেমন কাজ নাই। বিশেষ কোনো ক্লায়েন্ট ভিজিটে গেলে সে গাড়িটা নিয়ে যায়। নাদিয়াকে নিয়ে সে ভাড়া গাড়িতেই ঘোরে। অন্য সময় ছুটির পরে স্টাফদের নামিয়ে দিয়ে আসে। আজ সবাইকে নামিয়ে দিয়ে এলে, বেরোলো সে। ছোট একটা সিলেট শহর, রিকশা করেই প্রায় সব কাজ সারা যায়। ক্যাম্পাসের নাম করে রিকশা নিয়ে নিল সে। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে, কাপড় বদলে তারপর যেতে পারত, কিন্তু সেসব মাথায় এল না তার। তার বদলে ভাবতে লাগল, খুব খুশি থাকলে, নাদিয়া হঠাৎ নিজের বানানো দুই একটা লাইনে সুর বসিয়ে গেয়ে ওঠে। তারপর বলে, ‘এটা এখনই বানাইলাম, বুঝছ? একদম ইনস্ট্যান্ট!’
কবি নয় নাদিয়া, গল্পকার। কিন্তু তার গল্পের চেয়ে এসব দুই লাইনের গান বা প্রেমপত্র বেশি পছন্দ করে দুলাল। তার বাসার কম্পিউটারের ডি ড্রাইভে একটা ফোল্ডার আছে, নাদিয়ার কবিতা! যেসব কথা নাদিয়া বলেই ভুলে যায়, সেসব লিখে রাখে দুলাল। না, দুলালের এসব হাস্যকর কা-ের খবর জানে না নাদিয়া।
রিকশা এসে থামল প্রশান্তের বাড়ির সামনে। দুলাল ভাবল, প্রশান্তের নাম যদি প্রশান্ত না হতো, আর ওর বউয়ের নাম যদি শান্তি না হতো, তাহলে আজকের সদা আনন্দের দিনে এদের দাওয়াত কবুল করত না সে। সদা আনন্দের সঙ্গে শান্তি আর প্রশান্তির ঘনিষ্ট যোগ আছে না? বেল বাজাতেই হই হই করে দরজা খুলল প্রশান্ত। খুলেই বলল, ‘শালা অফিসের কাপ্রেই চইলা আইছিস!’ এতক্ষণে নাদিয়ার কবিতা থেকে বেরোতে পারল দুলাল, মনে হলো, আরে তাই তো, বাসায় গিয়ে আরাম জামাকাপড় পরে আসা যেত! জুতা মোজা খুলে ইনও খুলে দিয়ে বিল্যাক্স হয়ে দেখল, এলাহি কা-! বসার ঘরের টেবিল জুড়ে হরেক পানীয়ের সমাহার। শান্তি-প্রশান্ত ছাড়াও আরেক বন্ধু দম্পতি, পলাশ-তানিয়া এসেছে। এরা বাচ্চাদের কই পাঠিয়েছে, কে জানে! পাচজনে মিলে শুরু হলো, প্রি ডিনার পান। ভ্যাট সিক্সটি নাইন দিয়ে শুরু হলো। প্রশান্তের হাতে গ্লাস উঠলেই মাতাল হয়ে যায় সে। আর তার শুরু হয় কথা, বলল, ‘শালা দুলাল তুই বিয়া করলি না ক্যান?’ অন্য দিন প্রশান্তের কথায় তারা বেশি তাল দেয় না। কিন্তু আজ সবাই একযোগে হইহই করে উঠল, ‘হ্যাঁ কারেক্ট কোশ্চেন! আজ বলতেই হবে!’ পাঁচ পেগ পেটে নিয়ে দুলাল বলল, ‘ধুর শালা বিয়া যে একটা করার মতো কাজ, তাই মনে হয় নাই!’ এবার সবাই ঝিম! শান্তি বলল, ‘হ্যাঁ তাই তো, বিয়া কি একটা করার মতো কাজ?’ তানিয়া বলল, ‘কারেক্ট! ম্যারেজ ইস নট আ ভারব!’ কথাবার্তা ইংরেজিতে গেলে শান্তি বলল, মাতালদের ডায়লগ যখন ইংরেজিতে যায় তখন ডিনার ব্রেক দিতে হয়। কাজেই একপ্রস্থ ইউরিন খালাশ করে এসে তারা রাতের খাবার খেল।
দ্বিতীয় দফায় ভদকা, তানিয়া বলে ভোডকা! সেটা নিয়ে খানিকক্ষণ হাসাহাসি হলো। প্রশান্ত বলল, ‘যেন কইলি, বোটকা গন্ধ!’ কোনো ঘোষণা ছাড়াই গান ধরল তানিয়াÑসদা থাকো আনন্দে! গান শুরুর আগে সে একটা গলা খাকারি পর্যন্ত দিল না। গানের মাঝখানেই দুলাল বলে উঠল, ‘ছোটবেলায় আঙুল চুষত কে কে? হাত তোল!’ একটা হাত ঠেস দিয়ে কিম্ভুত এক আসনে বসে ছিল পলাশ, দুই হাত উপরে তুলতে গিয়ে গড়িয়ে পরে গেল মেঝেতে। পড়া দেখে এবার হাসতে হাসতে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল সবাই। চিত হয়ে শুয়ে দুলাল বলল, ‘শালা তোরা জানিস না, আজ সদা আনন্দে থাকার দিন!’
নাদিয়া বলল, ‘জান না, আমি টেলি সামাদের চ্যালা, নিজের গান ছাড়া গাই না!’
বারোটার সময় পলাশ বলল, ‘ওই তরা বাসায় যাইবি না?’ ত্রিং করে উঠে পড়ল দুলাল, জুতা পরতে পরতে বলল, ‘হ, গ্যালাম!’ শান্তি বলল, ‘একলা যাইতে পারবি?’ দুলাল বলল, ‘ধুর হালা, পাড়ুম না ক্যালা?’
রিক্সা বাসার গলিতে ঢুকতেই দূর থেকে দুলাল দেখল, শোবার ঘরে লাইট জ¦লে। জোরে জোরেই বলল, ‘ছালা ছকালে বাত্তি বুত্তি নিবাই নাইক্কা?’ রিকশাওয়ালা প্যাসেঞ্জারের কথায় হাসতে হাসতে বলল, ইতা কিতা মাতেন?
চাবি ঘুরিয়ে বাসায় ঢুকে দরজা বন্ধ করতে করতেই নাদিয়ার গন্ধ পেল সে। শোবার ঘরে ঢুকে দেখল, বিছানায় ঘুমিয়ে আছে নাদিয়া! চোখ বন্ধ করে দুলাল বলল, ‘আহ বিউটিফুল পোয়েট্রি, তুমি সত্যিই এসেছ?’ একটু আগের পুরান ঢাকাইয়া মাতাল ভাব একেবারে উড়ে গেছে। নাদিয়ার পায়ের কাছে মেঝেতে বসে, পায়ে চুমু খেল। ভাবল, পায়ের আঙুলকেও কনিষ্ঠা, অনামিকা, মধ্যমা বলে নাকি? নাদিয়ার পায়ের অনামিকা আর মধ্যমা সমান, দুইটা আঙুল একসাথে মুখে নিয়ে জিভ দিয়ে আদর করল। তবু ঘুম ভাঙল না তার। এবার হামাগুড়ি দিয়ে মাথার কাছে গেল, চুমু খেল ঠোঁটে। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘সত্যিই এসেছ?’ চোখ বন্ধ রেখেই নাদিয়া বলল, ‘হুঁ।’ হাসতে হাসতে উঠে বসল। এবার ভালো করে চোখ ডলে দুলাল বলল, ‘এই তুমি বাসায় ঢুকলা কিভাবে?’ ‘দেখ তোমার চাবি গোছা চেক করে, বাসার চাবি দুইটা ছিল না? একটা নিয়ে গেছিলাম আগের বার।’ হো হো করে হাসল দুলাল, ‘তুমি নাকি কোনোদিন চুরি-চামারি করো নাই!’
চোরের অপবাদ পাত্তা না দিয়ে নাদিয়া বলল, ‘গান শুনবা?’
‘বাপরে! তুমি তো ঘোষণা দিয়া গান শোনাও নাই কোনোদিন! আজ কী হইলো হঠাৎ?’
‘আজ স্পেশাল ব্যাপার, আজ পুরা গান!’
‘শুয়ে শুয়ে শোনা যাবে?’
‘যাবে, আসো।’
বিছানায় উঠে নাদিয়ার পাশে শুয়ে পড়ল দুলাল, ‘তুমি গান গাইতে থাকো, আমি আদর করি, ওকে?’
নাদিয়া যেন আজ কোনো কিছুতেই না বলবে না বলে ঠিক করেছে। যেন সদানন্দের ঝুলি নিয়ে নিজেই চলে এসেছে দুলালের সিলেট উপশহরের এই বাসায়। বলল, ‘ওকে!’
দুলাল নাদিয়ার ডান হাতের অনামিকা চুষতে চুষতে বলল, ‘নিজের গান শোনাবা?’
নাদিয়া বলল, ‘জান না, আমি টেলি সামাদের চ্যালা, নিজের গান ছাড়া গাই না!’
আদরে কেঁপে কেঁপে যেতে লাগল নাদিয়ার গান, দুলালের মনে হলো, এ গানের সুর এমনই। এটা নাদিয়ার আদরিয়া গান। যেন আদরের সময় গাইবে বলেই এটার সুর এমন হয়েছে। ভাওয়ায়া গানের মতো থেমে থেমে। ঘুমে ডুবে যেতে যেতে দুলালের মনে হলো, আহা আজ কতই না আনন্দে থাকলাম!
পরের দিন শুক্রবার দুপুরবেলা ঘুম ভাঙল তার। মাথা ভার হয়ে আছে, উঠতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো, কাল রাতে নাদিয়া এসেছিল! তড়াক করে উঠে গেল। খুঁজল সারা বাসা, নাই! তারপর চাবির গোছা দেখল, চাবি আছে দুইটাই!
তারপর জোরে হেসে উঠে সে বলল, ‘শালা দুলাল, সদা আনন্দে থাকতে, সিনেমার মতো মাতাল হইয়া নাদিয়ার ভূত নিয়া আসতে হয় তোর?’ হ্যাঙওভারের বিছানায় গড়িয়ে পড়তে পড়তে শুনল, কবিগুরু একেবারে নিজের গলায় গান ধরেছেন, ‘সদা থাকো আনন্দে, হে দুলাল!’