সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমের ৮ বছর কারাদন্ড
ডেস্ক রিপোর্ট : ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির জবানবন্দি ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনকে আট বছরের কারাদন্ডদিয়েছেন আদালত।
বৃহস্পতিবার দুপুরে বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন দু’টি ধারায় মোয়াজ্জেমকে মোট আট বছর কারাদ- দেন। একইসঙ্গে তাকে ১৫ লাখ টাকা অর্থদ-, অনাদায়ে দু’টি ধারায় আরও ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদ- দেওয়া হয়। রায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৬ ধারায় মোয়াজ্জেমকে পাঁচ বছর কারাদন্ড ও ১০ লাখ টাকা অর্থদ- এবং ২৯ ধারায় তিন বছর কারাদন্ডও পাঁচ লাখ টাকা অর্থদ- দেওয়া হয়।
অর্থদন্ড অনাদায়ে তাকে আরও ছয় মাস কারাদ- দেন আদালত। এ ছাড়া আইনের ৩১ ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মোয়াজ্জেমকে খালাস দেওয়া হয়। সাজা ধারাবাহিকভাবে কার্যকর হবে বিধায় ওসি মোয়াজ্জেমকে আট বছরই কারাদন্ড ভোগ করতে হবে এর আগে, সকাল পৌনে ১০টার দিকে ওসি মোয়াজ্জেমকে আদালতে নেওয়া হয়। দুপুর সোয়া ২টার দিকে তাকে এজলাসে তোলা হয়। এজলাসে তোলার আগ পর্যন্ত তিনি কোর্ট হাজতে ছিলেন বলে জানান ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত হাজতের ওসি মইনুল ইসলাম। গত ২০ নভেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে মামলার রায়ের জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করেন বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন। নুসরাত জাহান রাফিকে ‘অসম্মানজনক’ কথা বলা ও তার জবানবন্দি ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল সাইবার ট্রাইব্যুনালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বাদী হয়ে মামলাটি করেন। ওই দিনই আদালত এ মামলার তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। গত ২৭ মে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রীমা সুলতানার পক্ষে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় পিবিআই। ওইদিনই প্রতিবেদন গ্রহণ করে মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। পরবর্তীতে ১৬ জুন রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতার করা হয়। সেই থেকে তিনি কারাগারেই রয়েছেন। ১৭ জুলাই আদালত আসামি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। প্রায় চার মাসের এ বিচারকালে বাদী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন, নুসরাতের মা, ভাই, দুই বান্ধবী, দুই পুলিশ সদস্য ও তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ১২ জন রাষ্ট্রপক্ষে আদালতে সাক্ষ্য দেন। ১২ নভেম্বর তদন্ত কর্মকর্তার জেরার মাধ্যমে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ১৪ নভেম্বর ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারা অনুযায়ী আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দেন ওসি মোয়াজ্জেম। সর্বশেষ গত ২০ নভেম্বর এ মামলায় উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত রায়ের জন্য ২৮ নভেম্বর দিন ধার্য করেন। চলতি বছরের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার বিরুদ্ধে নুসরাতের শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন তার মা। পরে ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সিরাজ-উদ দৌলাকে গ্রেফতার করা হয়। এদিকে অভিযোগ দেওয়ার সময় নুসরাতকে আপত্তিকর প্রশ্নের পাশাপাশি তার বক্তব্য ভিডিও করেন ওসি মোয়াজ্জেম। পরে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মৌখিক অভিযোগ নেওয়ার সময় ভিডিওতে দু’জন পুরুষের কণ্ঠ শোনা গেলেও সেখানে নুসরাত ছাড়া অন্য কোনো নারী বা তার আইনজীবী উপস্থিত ছিল না। পরবর্তীতে গত ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষার আগমুহূর্তে মিথ্যাচার করে নুসরাতকে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে চাপ দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে অস্বীকৃতি জানালে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে পালিয়ে যায় তারা। পরে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতাল ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাতের মৃত্যু হয়। নুসরাতের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলায় এরইমধ্যে অধ্যক্ষ সিরাজসহ ১৬ জনকে মৃত্যুদ- দিয়েছেন ফেনীর একটি আদালত।
সন্তুষ্ট নুসরাতের পরিবার: ওসির বিরুদ্ধে এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার সাবেক ছাত্রী ও নির্মম হত্যাকা-ের শিকার নুসরাত জাহান রাফির মা শিরিন আখতার। তিনি এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আদালাত বিচার বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে রায় দিয়েছেন, আমি আদালতে ওসির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলাম। নুসরাতের মা বলেন, এ রায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, আর কোনো পুলিশ কর্মকর্তা কোনো মেয়ের সঙ্গে এমন আচরণ করার সাহস পাবেন না। কোনো হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার সাহস আর কোনো পুলিশ কর্মকর্তা পাবেন না। এ রায়ের মাধ্যমে নুসরাতের বিদেহী আত্মাও খুশি হবে বলেও জানান নুসরাতের মা। নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, এ রায়ের মাধ্যমে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে অপরাধী যেই হোক তাকে ছাড় দেওয়া হয়নি। নুসরাতের ভাই নোমান এমন রায়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানায়। অপরদিকে ওসি মোয়াজ্জেমের এ রায়ে শুধু নুসরাতের পরিবার নয়, স্বস্তি বিরাজ করছে পুরো ফেনীতে। ফেনীর সোনাগাজী, ছাগলনাইয়া ও মডেল থানা এলাকার মানুষদের মধ্যে বিরাজ করছে স্বস্তি। নুসরাতের সহপাঠী ও সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বলছেন এ রায় ওসির জন্য সঠিক বিচার হয়েছে। নুসরাতকে যে অপমান তিনি করেছেন তার সঠিক বিচার এটি। উল্লেখ্য নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার সময় পরীক্ষাকেন্দ্রে পুলিশ ছিল। তারপরও এ ধরনের ঘটনা কীভাবে ঘটলো? দোষিরা কীভাবে পালিয়ে গেলেন। ওই ঘটনার তিনদিন পরও আসামি গ্রেফতারে পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তার ভাইয়ের দায়ের করা হত্যাচেষ্টা মামলাটি রূপান্তরিত হয় হত্যা মামলায়। তখন অভিযোগ ওঠে, ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতের মৃত্যুর বিষয়টি ‘আত্মহত্যা’ বলার চেষ্টা করেন।
আপিল করবেন মোয়াজ্জেম: আট বছরের সাজার রায়ে সংক্ষুব্ধ ওসি মোয়াজ্জেমের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ জানিয়েছেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন। গতকাল বৃহস্পতিবার রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ কথা বলেন। ফারুক আহম্মেদ বলেন, মামলার প্রয়োজনে ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করেন। পিবিআইয়ের যে কর্মকর্তা মামলার তদন্ত করেছেন, তিনিও অনেকের বক্তব্য রেকর্ড করেছেন। তাই যে রায় হয়েছে, তাতে আমরা সংক্ষুব্ধ। এই রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব। রেকর্ড করা বক্তব্য রিলিজ করে দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই ভিডিও মোয়াজ্জেম সাহেব রিলিজ করেননি। তার মোবাইল থেকে ওই ভিডিও খোয়া গিয়েছিল।