সুজানগরে তিন সন্তানের জননী মৃত্যু ; হত্যা না আত্মহত্যা
পিপ (পাবনা) : সুজানগরের দুর্গাপুরের তিন সন্তানের জননী রুমার মৃত্যু নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধ্রুমজাল, তার পরিবারের সদস্যরা বলছে স্বামী ও শ^শুরবাড়ির লোকজন তাকে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। আর স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলছে তারাও বুঝছেন না কেনো এমন ঘটনা ঘটলো। বিষয়টি নিয়ে তারাও চিন্তিত কেনো এভাবে মারা গেলো রুমা। পুলিশ বলছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসার পরেই মূল ঘটনা বের হয়ে আসবে। অপরদিকে এলাকাবাসীর ভাবনাতে এখনও কাজ করছে ঘরবধূ রুমার মৃত্যু এটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড,নাকি আত্মহত্যা করেছে রুমা।
সুজানগরের ভায়না ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের মৃত হাছেন আলী মন্ডলের ছেলে বাচ্চু মন্ডলের সাথে ১৭ বছর আগে বিয়ে হয় আমিনপুর থানার বোয়ালিয়া গ্রামের মাহাতাব উদ্দিন শেখের মেয়ে রুমা খাতুনের। তাদের রয়েছে তিনটি ছেলে সন্তান। ১৪ বছরের বিজয়, ১৩ বছরের দুর্জয় ও সাড়ে ৬ মাসের তাছিন নামের একটি শিশু আছে তাদের। গত ৩১ অক্টোবর সন্ধ্যায় দুই ছেলেকে সাথে নিয়ে ইলিশ মাছ ও আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খায় রুমা। এসময় তার স্বামী বাচ্চু মন্ডল বাড়িতে ছিলেন না।
খাবার জন্য ছেলেদের বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে ডাকতেই রান্নাঘর থেকে শুধু সে বাড়ির উঠোনের বের হয় কয়েক মিনিটের জন্য। এসময়ও তার চুলোতে ছিলো ভাত ও ইলিশ মাছ রান্না করে উনুনে চড়ানো। রান্নাঘর থেকে খাবারপাত্র এনে, এরপরে ছেলেদেরকে আলুভর্তা করতে বলে রুমা। ছেলেরা আলু ভর্তা করলে সে তার দুই ছেলে বিজয় ও দুর্জয়কে সাথে নিয়ে সেটি খায়। এসময় রুমার খুব খারাপ লাগলে ছেলেকে বলে তোমার আব্বুকে ফোন করে সেভেনআপ আনতে বলো। সে মোতাবেক ছেলে কল করলে বাচ্চু মন্ডল খুব দ্রুত সেভেনআপ নিয়ে বাড়ি আসে। রুমা ও তার ছেলেদের সাথে সেভেনআপও খায় বাচ্চু মন্ডল। এরপরে রুমার সাথে প্রায় বিশ মিনিটের মতো কথা হয় তার স্বামী বাচ্চু মন্ডলের। তখন রুমা বলে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো। সেই মোতাবেক ব্চ্চাু ও তার পরিবারের সদস্যরা রুমা ও তার দুই অসুস্থ হয়ে পড়া শিশুকে নিয়ে সুজানগর স্বাস্থ্য কমেপ্লক্সে নেবার পথে রুমার মৃত্যু হয়।
আর দুই শিশু বিজয় ও দুর্জয়কে প্রথমে পাবনা ও পরবর্তিতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনদিন চিকিৎসার পরে বাড়ি নিয়ে আসা হয় দুই শিশু ভাইকে। কি খেয়ে রুমা মারা গেলো ও দুই শিশু অসুস্থ হলো তা আজো অজানাই থেকে গেছে সকলের কাছে। এঘটনায় সুজানগর থানায় ইউডি (অপমৃত্যু) মামলা হয়। এই মামলাটি করেন রুমার ভাই হুমায়ন কবির। তবে রুমা উনুনের ওপরে খাবার রেখে সন্তানদের রাস্তাতে ডাকতে যাবার অল্প সময়ের মাঝেই কি কেউ কোন কিছু মিশিয়ে দিলো খাবার ভেতরে, নাকি গ্যাসফোম করে সে মারা গেলো।
এমন কি খেলো সে যে সে মারা গেলো। একই খাবার খেয়ে রুমা মারা গেলো, অথচ শিশু দুজন বেঁচে গেলো কেটে গেলো তাদের অসুস্থতা। সব মিলিয়ে রুমার মৃত্যু এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা এ নিয়ে আলোচনা চলছে এলাকাতে। রুমার স্বামী বাচ্চু মন্ডল ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে এঘটনার জন্য দায়ী করে রুমার ভাই মহসিন কবির ও হুমায়ন কবির জানান, রুমার স্বামী তাকে বিয়ের পর থেকেই নির্যাতন করতো, বিয়ের পর থেকেই বাড়ি থেকে টাকা আনার জন্য চাপ প্রয়োগ করতো। এদিকে রুমার স্বামীর ভাইদের সাথেও তার সম্পর্ক জমিজমা কেন্দ্রীক ভালো ছিলো না। বৈষয়িক বিষয় নিয়ে তাদের মাঝে ছিলো দ্বন্দ। রুমা মারা যাবার কয়েকদিন আগেও ঐ বাড়িতে রুমার রোপণ করা গাছসব কেটে ফেলে তার স্বামীর ভাইয়েরা। রুমার স্বামী ও শ^শুরবাড়ির লোকজন পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ তাদের। মায়ের সাথে একইসাথে খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া ঐদিনের ঘটনা সম্পর্কে রুমার ছেলে দুর্জয় জানায়, আমরা বাইরে খেলছিলাম। মা ডেকে খাবার খেতে বলে একসাথে। ইলিশ মাছ ও আলু ভর্তা দিয়ে তারা একসাথে ভাত খায়। এরপরে অসুস্থ হলে মা বলে তোমার আব্বুকে ফোন দিয়ে সেভেন আপ আনতে বলো। ছেলে ফোন করলে বাচ্চু মন্ডল খুব দ্রুত সেভেন আপও নিয়ে চলে আসে বাড়িতে।
এরপরে খেয়ে কিছুক্ষন কথাও হয় তার সাথে স্ত্রী রুমার। এরপরে রুমা বলে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো। বাড়ি থেকে কিছুদুর যাবার পরে রাস্তাতেই মৃত্যুবরন করে রুমা। আর দুই ছেলে বিজয় ও দুর্জয়কে প্রেরণ করা হয় রাজশাহীতে। সেখানে একদিন চিকিৎসা নিয়ে চলে আসে দুই সন্তান। এসে মায়ের মৃত্যুমুখ দেখে কেঁদে ফেলে হাউমাউ করে। তাদের ছোট ভাই সাড়ে ছয় মাসের শিশু তাছিম বুঝলোই না এই বয়সে সে হারিয়ে ফেললো তার মাকে। মায়ের আদর থেকে ছিটকে গেলো তার জীবন কিছু বুঝে উঠার আগেই। অপরদিকে রুমার স্বামী বাচ্চু মন্ডল জানান, তার স্ত্রীর সাথে তার অনেক ভালো সম্পর্ক ছিলো। তার স্ত্রী সদালাপী ও নামাজি ছিলো। কোনদিন স্ত্রীর সাথে তার এমন কোন কিছু হয়নি যে সে আত্মহত্যা করবে। শ^শুরবাড়ির লোকজনের সাথেও তার ভালো সম্পর্ক, কিন্তু কোনদিন সে তার শ^শুরবাড়ি থেকে কোন টাকা পয়সা কিছুই নেইনি। তার অর্থনৈতিক অবস্থা এতোটা খারাপ নয় যে শ্বশুরবাড়ি তেকে টাকা আনতে হবে। বরং তিনিই শ্বশুরবাড়ির লোকদেরকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন বলে জানান। কিভাবে এই ঘটনা ঘটলো তা তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না।
তবে তার ভাইদের সাথে তার বৈষয়িক ঝামেলা রয়েছে উল্লেখ করে বলেন, জায়গা জমি সবই ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গেছে। এখন তো সম্পর্ক কারো সাথে খারাপ নয়। আর যেহেতু তিনি বাড়িতে ছিলেন না এবং কিছু নিজে দেখেননি, ফলে তিনি কি বলবেন তাও তার বোধগম্য নয়। বলেন, স্ত্রী রুমা মারা গেছে। এখন সে তার তিনটি সন্তান নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। ছোট ছেলেটার বয়স মাত্র ছয় মাস। তিনিও চান প্রকৃত ঘটনা নিজে জানতে। কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি। রুমার ছোট জা আশরাফুন নাহার বলেন, এধরনের ঘটনাতে তারা ব্যাথিত হয়েছেন। সে নিজে হাসপাতালে নার্সের চাকরি করেন।
ঘটনার সময়ে ছিলেন রুমার বাড়ির পাশেই নিজবাড়িতে। তিনি সাথে করে নিয়ে গেছেন হাসপাতালে। রুমার ব্যবহার আচার অনেক ভালো ছিলো জানিয়ে তিনি বলেন, তারা বিষয়টা এখনও ঠিক বুঝেই উঠতে পারেননি, প্রকৃত ঘটনাটা কি। রুমার বৃদ্ধা শ্বাশুড়ি গুলনাহার বললেন, আমার টিভি দেখতিছিলাম। বউ ছাওয়াল পোল লিয়ে খাবের বসলে, এরপরে চেঁচামেচির শব্দে তিনি ওখানে যান। এখন বিষয় খাইছে নাকি অন্য খাইছে।
ক্যাবা করে এতা হলো, তা উনি ঠিক বুঝবের পারতেছে না। এদিকে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট নিয়ে কোন কথা বলতে রাজী হননি পাবনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান। তবে একজন চিকিৎসকের সাথে কথা হলে তিনি জানান, ময়না তদন্তের প্রতিবেদন এখনও আসেনি। চিকিৎসক এও জানান, খাদ্যে বিষক্রিয়া বা বিষ খেয়ে কেউ হত্যার শিকার হলে বা আত্মহত্যা করলে সেই রিপোর্ট আসতে তিন চার মাস সময় লাগে। সারাদেশ থেকে ভিসেরা যায় ঢাকাতে। আর অন্ননালী সংশ্লিষ্ট রিপোর্ট পেতে একটু সময়ও লাগে বেশি।
এবিষয়ে জেলা পুলিশের প্রধান পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলাম বিপিএম পিপিএম জানান, ঘটনাটি তাদের নলেজে রয়েছে। এঘটনায় একটি ইউডি মামলা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট না আসা অবধি কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে রিপোর্টটি হাতে পেলে তারা প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করবেন। ঘরবধূ রুমার এই অনাকাংখিত মৃত্যুর ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ভূক্তভোগী হয়েছে তার তিন নাবালক শিশু।
এই শিশুরা এ বয়সে বুঝলো না তারা কি হারালো। ঘটনাটি অনেক মর্মান্তিক। যদি এটি আসলেই হত্যাকান্ড হয় তবে প্রকৃত আসামি যেন আইনের কঠোর ব্যবস্থা দেখতে পাই এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।