২৯ মার্চ ১৯৭১ পাবনা হানাদার মুক্ত দিবস
। আমিরুল ইসলাম রাঙা।
আজকের এইদিনে পাবনার মুক্তিকামী জনতা প্রায় দুই শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করে পাবনাকে প্রথম হানাদার মুক্ত করেছিলো এবং ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা জেলা হানাদার মুক্ত ছিল।
২৯ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা হত্যা করেছিলো আটঘরিয়া-ঈশ্বরদী থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য এডভোকেট আমিন উদ্দিন, পাবনা জেলা ন্যাপের সভাপতি ডাঃ অমলেন্দু দাক্ষী, মটর ব্যবসায়ী সাঈদ তালুকদার এবং রাজনকে। ২৯ মার্চ সকালে মালিগাছায় সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন আটঘরিয়া থানার দারোগা আব্দুল জলিল।
২৯ মার্চ সকালে দাপুনিয়া পাকশী সড়কের মাধপুর বটতলায় পলায়নরত পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয় বীর জনতার। সেখানে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন, শহীদ রাজু, শহীদ আব্দুর রাজ্জাক, শহীদ ওহিদুর রহমান, শহীদ আব্দুল গফুর, শহীদ আলী আহমেদ, শহীদ নবাব আলী এবং প্রমুখ।
একইদিন পলায়নরত পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে দাশুড়িয়া, মুলাডুলি, লালপুরের মধ্যে ১৭ টি স্থানে খন্ড খন্ড যুদ্ধে মেজর আসলাম সহ প্রায় দুই শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। অপরদিকে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রায় ২০/২৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের নামে গোটা দেশে হাজার হাজার নীরিহ মানুষকে হত্যা করে। তারই ধারাবাহিকতায় ২৫ মার্চ গভীর রাতে রাজশাহী সেনানিবাস থেকে দুই শতাধিক সৈন্য এসে পাবনা বিসিক শিল্পনগরীতে অবস্থান নেয়। ২৬ তারিখ ভোর থেকে পাবনা শহরে মাইকযোগে কার্ফ্যু জারী করে মানুষকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়।
২৬ মার্চ পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লা থেকে নব-নির্বাচিত সংসদ সদস্য এডভোকেট আমিন উদ্দিন, জেলা ন্যাপের সভাপতি ডাঃ অমলেন্দু দাক্ষী, মটর ব্যবসায়ী সাইদ তালুকদার সহ প্রায় শতাধিক মানুষকে আটক করে। তারা পাবনার ডিসি নুরুল কাদের খান এবং এসপি চৌধুরী আব্দুল গফফারকে তলব করে। তাঁরা পাকিস্তানি সৈন্যদের আহবানে সাড়া না দিয়ে পাবনার চরাঞ্চলে অবস্থান নেন।
২৬ মার্চ সকালে পাকিস্তানি সৈন্যরা পাবনার এসপি বাংলোতে হানা দিয়ে উনার বড় ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী মাহবুবর রহমান পান্নাকে আটক করে। সন্ধ্যায় কৃষ্ণপুর মহল্লায় জানাজা নামাজে গুলিবর্ষণ করে। এতে শেখ আব্দুস সামাদ নামে একজন মুসল্লী নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়।
২৭ মার্চ সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা পাবনা পুলিশ লাইন আক্রমণ করে। সেখানে পুলিশ বাহিনীর সাথে গুলিবিনিময় হয়। ২৮ তারিখ সকালের মধ্যে পুলিশকে অস্ত্রসমর্পনের নির্দেশ দেওয়া হয়। এদিকে পাবনা ডিসি, এসপি পাবনার মুক্তিকামী জনতার সাথে সংহতি প্রকাশ করে। ২৮ তারিখ ভোরে পাকিস্তানি সৈন্যরা পুনরায় পুলিশ লাইন আক্রমণ করলে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়।
পুলিশ লাইনে প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি সৈন্যরা পিছু হটে। সেখান থেকে পালিয়ে একদল বিসিক অভিমুখে যায়। আরেকদল বাণী সিনেমা হলের দক্ষিণ দিকে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আটকে পড়ে। ইতিমধ্যে পাবনা পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার খুলে দেওয়া হয়। মুক্তিকামী জনতা টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আটকে পড়া পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘিরে ফেলে। একটানা কয়েকঘন্টা যুদ্ধে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে অবস্থানরত প্রায় ২৮ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করা হয়।
ঐ একইদিন মুক্তিকামী জনতা দুপুরের পরে পাবনার বর্তমান বাসটার্মিনালে অবস্থিত পাকিস্তানি সৈন্যদের চেকপোস্টে আক্রমণ করে। সেখানে উভয়পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। সেখানে অবস্থানরত সমস্ত পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করা হয়। সেই যুদ্ধে চারজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন শহীদ বুলবুল ( যার নামে শহীদ বুলবুল কলেজ), আমিরুল ইসলাম ফুনু, মুকুল এবং আফসার উদ্দিন।
দুইদিনব্যাপী পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয় এবং ২৯ মার্চ পাবনা হানাদার মুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি বিরল ঐতিহাসিক ঘটনা সৃষ্টি হয়। ২৬ মার্চের পর বাংলাদেশের প্রথম জেলা শহর পাবনা হানাদার মুক্ত হয়। প্রথম জেলা যেখানে ডিসি, এসপি সহ প্রশাসনের প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রথম সংসদ সদস্য এডভোকেট আমিন উদ্দিনকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
পরিতাপের বিষয় হলো এমন একটি বিরল এবং ঐতিহাসিক ঘটনা আজ উপেক্ষিত। স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম হলেও ২৯ মার্চ পাবনার প্রথম হানাদার মুক্তের ইতিহাস স্মরণ করা হয় না। পাবনার ঐতিহাসিক টেলিফোন ভবন আজ পরিত্যক্ত এবং ধ্বংসপ্রায়। সেখানে গড়ে উঠতে পারে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্মারক চত্বর।
পাবনার ঐতিহাসিক টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনের স্থানে মুক্তিযুদ্ধ চত্বর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর অথবা ৭১ ফুট উচ্চতার একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হোক। সেখানে পাবনার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা খোদাই করে সংরক্ষণ করা হোক। সরকারি উদ্যোগে ২৮ মার্চ প্রতিরোধ যুদ্ধ দিবস অথবা ২৯ মার্চ পাবনা প্রথম হানাদার মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হোক। ( সমাপ্ত)
লেখক,
আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।
২৯ মার্চ ২০২২